আহলে বাইত ও শোহাদায়ে কারবালা

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যই ইমান। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘(হে নবী সা.) আপনি বলুন, “তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন”’ (সুরা-৩ আল ইমরান, আয়াত: ৩১)। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হব’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পরিচ্ছেদ: ৮, হাদিস: ১৩-১৪, পৃষ্ঠা: ১৯, ই. ফা.)। নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসার পূর্ণতা হলো আহলে বাইতের ভালোবাসায়। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে উল্লেখ করেছেন, ‘ (হে নবী সা.) আপনি বলুন, “আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, চাই শুধু আমার স্বজনদের (আহলে বাইতদের) প্রতি ভালোবাসা”’ (সুরা-৪২ শুরা, আয়াত: ২৩)।

আহলে বাইত হলো নবী পরিবার—হজরত ফাতিমা (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.) এই পরিবারের সদস্য। এঁদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে নবীবংশ। নবীবংশেরই ৭০ জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শাহাদত বরণ করেছেন আশুরার দিনে, ইরাকের কুফা নগরীর কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে।

রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘আমি জ্ঞানের নগর, আলী তার সদর দরজা’ (তিরমিজি)। ‘আমি যার বন্ধু আলীও তার বন্ধু’ (তিরমিজি: ৩৭১৩, ইবনে মাজাহ: ১২১)। ‘হজরত ফাতিমাতুজ জোহরা (রা.) হলেন জান্নাতি রমণীদের প্রধান’ (মুস্তাদরাকে হাকেম,৩: ১৮৫, সিলসিলাতুস সহিহা লিল আলবানি,৩: ৪১১)। ‘হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.) হলেন বেহেশতি যুবকদের সরদার’ (মুসনাদে আহমাদ, ১৭: ৩৭)। ‘কারবালা’ ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রান্তর, যেখানে ৬২ হিজরির মহররম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবারে নবীদৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) অত্যন্ত করুণভাবে শাহাদত বরণ করেছিলেন। মানবতার ইতিহাসে এটি অত্যন্ত বিয়োগান্ত ঘটনা। কারবালা যেন আরবি ‘কারব’ ও ‘বালা’–এর সরল রূপ। ‘কারব’ মানে সংকট, ‘বালা’ মানে মুসিবত। তাই কারবালা সংকট ও মুসিবতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনা মহিমাময় মহররম মাসের ঐতিহাসিক মহান আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় এতে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। এতে এই শাহাদতের মাহাত্ম্য যেমন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আশুরা ইতিহাসে নতুন পরিচিতি পেয়েছে। আজ আশুরা ও কারবালা বা কারবালা ও আশুরা সমার্থক; একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘ফোরাত’ কুফার একটি সুপ্রাচীন নদী, এই নদীর কূলে অবস্থিত কারবালার প্রান্তর। হুসাইনি কাফেলা যখন কারবালায় অবস্থান করছে, তখন তাদের পানির একমাত্র উৎস এই ফোরাত নদী কুফার শাসক উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী ঘিরে রাখে, অবরুদ্ধ করে রাখে নিরস্ত্র অসহায় আহলে বাইতের সদস্যদের। এই নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে গেলে ফুলের মতো নিষ্পাপ দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর সিমারের বাহিনীর তিরের আঘাতে শহীদ হয়।

এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কুফাবাসী হজরত হুসাইনকে (রা.) পত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানে গেলে তারা তাঁকে একাকী বিপদের মুখে ফেলে রেখে নিজেরা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে। কারবালা আজও ঘটে চলেছে দেশে দেশে। দুনিয়ার প্রতিটি নদী আজ ফোরাতের কান্না করছে। কুফা যেন সিন্দাবাদের ভূত হয়ে মানবতার ঘাড়ে চেপে বসেছে। দামেস্ক, তুরস্ক ও মিসরের সে খলনায়কদের প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের অজ্ঞানতার তমসায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত কারবালার প্রান্তরে নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নে পরাজিত প্রতারিত হুসাইনি কাফেলা চিরস্মরণীয় ও বরণীয়। প্রতিটি আশুরা ও শোহাদায়ে কারবালা দিবস আমাদের নতুন পথ ও নতুন জীবনের প্রতি অনুপ্রেরণা জোগায়। জীবনের ব্রত, ত্যাগের শিক্ষা, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে; ভয়কে জয় করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে, রক্তলাল মুক্তির পথ তৈরি করে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ পথ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করাই শোহাদায়ে কারবালার মহতী শিক্ষা।

শোহাদায়ে কারবালা দিবস মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক শোক দিবস। কারবালার শিক্ষা হলো সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রয়োজন নবীপ্রেম, আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মনিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পালন, মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা। ভোগ নয়, ত্যাগেই সুখের সন্ধান করা। যেদিন সমগ্র পৃথিবীতে পরিপূর্ণরূপে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সত্য ও সুন্দরের জয় হবে, সেদিনই কারবালার প্রায়শ্চিত্ত হবে। সার্থক হবে আহলে বাইতের আত্মদান। 

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com