গ্রামীণ মায়ার জিত ও বিস্ময়কর শাহ আবদুল করিম

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬-১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬-১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

আমি অন্তত বিশ্বাস করিনি, মরা গাঙে এমন জোয়ার আসবে। আমাদের আধুনিক গানের জমিন যখন খটখটা শুকনো, বড় কোনো প্রতিভা সেখানে অনেক কাল হলো আসছে না, তখন কিনা আবির্ভূত হলেন নাইওরজানের পুত্র, কালনী নদীর জাতক, ভাটির কবিয়াল শাহ আবদুল করিম। তিনিই প্রমাণ, শহরে যা–ই চলে চলুক, বাংলা মায়ের ভান্ডারে এখনো বিবিধ রতনের দেখা মেলে। আধুনিকতার বাহির থেকে তাঁর উদ্ভব বোঝায়, লোকজগতে হয়তো এখনো অন্তঃসলিলা গানের ধারা বয়ে চলেছে, আমরা জানতে পারি না। আমার ওই ব্যক্তিগত দ্বিধা কাটিয়ে দিয়েছিলেন বাউলকুলের নতুন রাজা শাহ আবদুল করিম। আমি ভাবতাম, আধুনিকতার ব্যথা ও বিচ্ছেদ বুঝি আমাদের লোককাব্য ও সংগীতের ধারাকে শুকিয়ে মেরেছে। দিলখোলা গ্রামসমাজ ছাড়া, নদী ও প্রকৃতির মধ্যে বিচরণ করা ছাড়া বোধ হয় মহৎ কোনো লোককবি আর বাড়তে পারবেন না।

ভাটি অঞ্চলে শাহ আবদুল করিম জনপ্রিয়ই ছিলেন। কিন্তু যত দিন না ঢাকার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে চিনল, তত দিন তিনি তথাকথিত সুধীসমাজে অচল ছিলেন, অচেনা ছিলেন। মৃত্যুর কিছু আগে তিনি স্বীকৃতি পেলেন, বাজারও পেলেন। তাও তো পেলেন। যাকে বলে রাজধানী তা শুধু ক্ষমতারই কেন্দ্র না, তা ধারণ করে মিনিং জেনারেটিং পাওয়ার—মূল্যায়নের ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা যখন কলকাতায় ছিল, তখন আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীম, রমেশ শীল, কাজী নজরুলদের কলকাতায় গিয়ে সার্টিফিকেট নিতে হতো।

শাহ আব্দুল করিমকে তাঁর ভাটি অঞ্চলের মানুষ ঠিকই জানতো ও ভালবাসতো। ঢাকার লোকেরাই বরং এমন প্রতিভা বিষয়ে বেখবর। স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকা অনেক সময় কলকাতার মতোই আচরণ করে। যতক্ষণ না ঢাকার মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি কাউকে না চিনছে বা না চেনাচ্ছে ততক্ষণ সেই শিল্পীর কদর নাই। লালনকে তাঁর জগতের মানুষ ঠিকই চিনতো ও মানতো—সেইসব মানুষের কাছে লালনকে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু ছিল না। ভাষায় ও সুরে সহজে চিনতে পারার কারণ হলো তাঁদের শ্রোতা–ভক্তদের অনুভবের রকমসকম লালন বা শাহ সাহেবের মতোই। তাঁরা ছিলেন ওই গ্রামজনতার কাছের মানুষ। শহুরে শিক্ষা ও চালচলন এবং বিদেশি সংস্কৃতির রস ওই গ্রামীণ ভাবকাঠামো থেকে আমাদের দূরে সরায়। সংস্কৃতির ওই ভাঙ্গা সেতু পেরিয়ে তখন গ্রামের শিল্পীরা আর শহরে আসর জমাতে পারেন না, স্বীকৃতিও মেলে না। ‘আমি চঞ্চল হে’ হলো আধুনিকতার ভাব আর বাউলা ভাব হলো ‘আমার অঙ্গ জরজর’। বঝুলে পরে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা।

ঠিক এমন করে একদিন উঠে এসেছিলেন আব্বাসউদ্দীন। সেটা এমন সময়, যখন কলকাতায় মুসলমান শিল্পীর রেকর্ড বিকাত না। আব্বাসউদ্দীনের পরে এমন হলো যে হিন্দু শিল্পীরাও মুসলমান নামে রেকর্ড বের করতেন। পূর্ব বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক ঘরানার প্রতিষ্ঠায় আব্বাসউদ্দীনের অবদান বিপুল। সে সময়ের একটি ঘটনা। বিখ্যাত কোনো নেতাকে নিয়ে জনসভা হবে। তো আয়োজকেরা ঠিক করলেন, বক্তৃতার আগে আব্বাসউদ্দীনের কয়েকটা গান হবে। নেতা তো বিরক্ত। তাঁর সময় নেই। তা ছাড়া এসব পল্লিগীতি তো নিচুতলার গান। অপমানিত আব্বাসউদ্দীন তাঁকে বললেন, ‘আমি শুধু একটা গান গাইব। তারপর চলে যাব।’

আব্বাসউদ্দীন গাইলেন, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’।

গান শেষ হলে দেখা গেল, সেই নেতার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নেতার ছেড়ে আসা গ্রামের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আব্বাস উদ্দীনকে সেদিন বেশ ক’টা গান গাইতে হয়। গ্রাম মানবজাতির শৈশব। মানুষ চিরকাল শহরে থাকেনি। গ্রামীণ সুরে অনেকেরই আত্মা দুলে ওঠে। তখন মনে পড়ে, নগরজীবনেও আমাদের প্রাণটা ফাঁদে পড়া পাখির মতোই কাঁদছে।

শাহ আবদুল করিমের ভাটির সুরের গান শুনে মনের তলায় জল ছলছল করে। বাঙালি মন লোকসুরের জাদুতে যত ভোলে, আর কিছুতে ততটা মজে বলে মনে হয় না। মায়ার টান খুব শক্তিশালী, যেমন তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে’! এই মায়ার টানে তিনি কোনোদিন কালনি নদী ছেড়ে যাননি। মায়ার টানে পড়েই গ্রামীণ মানুষের সুখ–দুঃখ, প্রেম–ভালাবাসার ব্যালাড রচনা করে গেছেন। গ্রিক নন্দনের শক্তি যেমন ট্র্যাজিক চেতনা, বাংলা সংস্কৃতির মর্মে তেমন পাই মায়া। মানুষের প্রতি মায়া, ছেড়ে আসা গ্রামের প্রতি মায়া, প্রকৃতির প্রতি মায়া—এমন হাজারো মায়ার টানে ভোগা মানুষ জানে, মায়ার বন্ধন কত শক্তিশালী। মৃত্যু ছাড়া তার বন্ধন নাকি ছেঁড়া যায় না।

শাহ আবদুল করিমের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম ছেঁকে নিলে যা পাই, তা এই মায়া। মায়া বাংলাদেশের কৃষক সংস্কৃতির মূল রস। এটা আমাদের আধুনিক সাহিত্যেও ছড়িয়ে গেছে। হ‌ুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের চরিত্রগুলোর প্রতি যে মায়া জাগে, তাও ওই মায়াধর্মের কারণেই। লেখকের কন্যা শীলা আহমেদ প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাবার বইয়ের মধ্যে একটা মায়া আছে, পড়া শেষে একটা হাহাকার লাগে, চরিত্রগুলোর প্রতি একধরনের মায়া তৈরি হয়...না হলে মানুষ তাঁর বই এত পছন্দ করবে কেন? তারাও নিশ্চয় বাবার তৈরি ওই চরিত্রগুলোর মায়াতে আটকে যায়।’

জীবনানন্দ দাশের কবিতা, হ‌ুমায়ূনের গল্প-উপন্যাস, এমনকি শাহ আবদুল করিমের গানে এই মায়ারই আবেশ ছড়ানো সংসার। বঙ্কিমচন্দ্র-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তিকে বড় করে দেখেছেন, রামমোহন বড় করেছিলেন দয়াকে। যাকে ভক্তি করি, তার দয়াই তো চাওয়া হয়। ভক্তি ও দয়া সবই উচ্চ থেকে নিম্ন দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু মায়ার স্রোত বহে সমানে সমানে, সমান্তরালে। মায়ার পরশে এখানে ক্ষমতাসম্পর্ক অনেকটা অবশিত বা হালকা হয়ে আসে। এ কারণে মায়াকে ধরে আমরা আরও কাছাকাছি আসতে পারি। প্রেম ফুরালেও তাই মায়া ফুরায় না আমাদের।

বৈদিক দর্শনে মায়াকে ইল্যুশন বা বিভ্রম অর্থে বোঝা হয়েছে, কিন্তু নিম্নবর্গীয় ভাষায় মায়াই বাস্তব। এই দুই মায়া তাই এক না। আমরা লোকায়ত মায়ার পক্ষপাতী। আমাদের শহুরে শামিয়ানার বাইরে থেকে লাখো ছেলেমেয়ে তাদের গ্রামীণ অনাঘ্রাত শৈশব নিয়ে উঠে আসছে। উঠে আসছে মায়ার ছায়া থেকে। হয়তো তাদের থেকে গানে-কবিতায় তেমন করে কেউ আসবে—যেমন করে এসেছিলেন বাউল শাহ আবদুল করিম। এবং তিনি একা নন। লোকগানের উজ্জ্বল ছায়াপথে অনেক নক্ষত্রের শেষ পুরুষ তিনি। তিনি সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ও রাধারমন, নরসিংদীর দ্বিজদাস ও হরিচরণ আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমোহন দত্ত, নেত্রকোনার লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎ চন্দ্র নাথ), কিশোরগঞ্জের রামু মালি, রামগতি শীল ও রামকানাই নাথ এবং রশিদ উদ্দিন ও জালালউদ্দীন খাঁয়ের উত্তরাধিকার।

২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কালনি নদীতীরে তিনি চিরবিদায় নেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস তিনি অনেক বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও ভাষা যে এখনো শিল্পের বিরাট আধার তাও জানিয়ে গেলেন। এই আত্মবিশ্বাসের খোঁজ স্বভূমে যারা পরবাসী তারা জানে না।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]