মাটিডাঙ্গা, উগান্ডা এবং সড়ক দুর্ঘটনা

এক দেশে একটা রাস্তায় হঠাৎ খুব বেশি দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করল। মহাসড়কের একটা জায়গায় আরকি!

তখন দেশের সংবাদপত্রগুলো খুব হইচই শুরু করল। ধরা যাক, জায়গাটার নাম মাটিডাঙ্গা। খবরের কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হলো: মাটিডাঙ্গা মরণফাঁদ।

সারা দেশের চেয়ে মাটিডাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ২০০ গুণ বেশি।

সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় লেখা হলো: আর কত মায়ের কোল খালি হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?

উপসম্পাদকীয় কলামে লেখা হলো এই দেশে সবকিছুর দাম বাড়ে, শুধু মানুষের দাম কমে! প্রতিদিন বাড়ছে লাশের মিছিল। যন্ত্রদানব কেড়ে নিচ্ছে মানবের অমূল্য জীবন! তবু কারও কোনো বিকার নেই কেন? মাটিডাঙ্গার সড়ক দুর্ঘটনা সমস্যার সমাধান অবিলম্বে চাই।

একজন বুদ্ধিজীবী নিরামিষভোজী সাংবাদিক প্রেসক্লাবের সামনে অনশন শুরু করলেন। মাটিডাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনা সমস্যার সমাধান চাই-ই চাই।

কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল। তাঁরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করলেন। তদন্ত কমিটি সড়ক বিভাগ, পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং পালি ভাষা শিক্ষা কমিটির ৩৪৬ জনকে পাঠাল উগান্ডা। উগান্ডায় কেন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, কিংবা ঘটে না, তা দেখে এসে মাটিডাঙ্গার সড়ক দুর্ঘটনা সমস্যার সমাধানে দিকনির্দেশনা চাই।

৩৪৬ জনের প্রত্যককে হাতখরচ হিসেবে দেওয়া হলো দুই লাখ টাকা করে। গেল ৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। প্লেনের টিকিট, হোটেল-মোটেল, খাওয়াদাওয়া, সাইট সিয়িং করতে চলে গেল আরও ২১ কোটি।

তাঁরা ফিরে এলেন। বললেন, ভালো জ্ঞান হয়েছে। উগান্ডায় একটা রাস্তা পাওয়া গেছে, যেখানে অ্যাকসিডেন্ট হয় না, কারণ ওই একটা রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই। আমাদের দেশে মহাসড়কে যদি আমরা কোনো গাড়িঘোড়া চলতে না দিই, শুধু হেঁটে সবাই চলাচল করে, তাহলে আর সড়ক দুর্ঘটনা হবে না।

উফ্‌। এই দেশে সত্য কথার দাম নেই, আর মৌলিক জ্ঞানের কোনো কদর নেই। গণমাধ্যমগুলোয় ব্যাপক সমালোচনা করা শুরু হলো। কান পাতা দায়।

তখন তিন সদস্যবিশিষ্ট একটা টাস্কফোর্স গেল মাটিডাঙ্গায়। ওখানে কেন এত দুর্ঘটনা ঘটে। তারা সেখানে গিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলল। জনগণই সকল জ্ঞানের উৎস। তারা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলল। তারা আহত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলল। জানা গেল, মাটিডাঙ্গায় মহাসড়কের মাঝখানে একটা গর্ত আছে। সেই গর্তে পড়ে গাড়িঘোড়াগুলো ‘অ্যাকসিডেন্ট’ করছে।

আসলে, কারণ জানা গেলে সমস্যার কিন্তু ৯৯ ভাগ সমাধান সম্ভব।

তখন ওই গর্তের দুই পাশে লাল কালিতে লেখা নোটিশ বোর্ড স্থাপন করা হলো, দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। সাবধানে গাড়ি চালান। একটা দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না।

তাতে দুর্ঘটনা কমল না।

তখন চালকদের জেল-জরিমানা করার চেষ্টা করা হলো। চালকেরা ধর্মঘট করে সেই অপচেষ্টা অঙ্কুরেই থামিয়ে দিতে সক্ষম হলেন।

তখন ঠিক করা হলো চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কিন্তু সে বড় দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। দুর্ঘটনা তো ঘটেই চলেছে।

পত্রিকাগুলো রোজ লেখে। সমালোচনার জ্বালায় কর্তৃপক্ষের ঘুম হারাম। তাঁরা তাঁদের গণসংযোগ বিভাগ ঢেলে সাজালেন। তবু কোনো উন্নতি নেই।

তাঁরা এ বিষয়ে কোনো কিছু লেখা হলে আইসিটি আইনে ধরার হুমকি দিলেন। তবু গণমাধ্যম তো বটেই, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম আরও বেশি চেঁচামেচি করতে শুরু করল।

এবার অতি উচ্চপর্যায়ের কমিশন গঠিত হলো। সেটার সদস্য তিনজন। সড়কমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। তাঁরা তাঁদের সচিব, মহাপরিচালক, পরিচালক, চিফ ইঞ্জিনিয়ার—সবার সঙ্গে কথা বলে প্রস্তুত হয়ে এসেছেন।

সড়কমন্ত্রী অনেক ভেবেচিন্তে স্লাইড দেখিয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন করলেন। তিনি বললেন, আসলে আমরা বানরের পা না ধরে লাঠি ধরে টানাটানি করছি। আসল কারণ তো হলো মহাসড়কের ওই গর্ত। আমরা ওই গর্তের ওপর দিয়ে একটা ফ্লাইওভার বানাব। স্লাইডে দেখা গেল, থ্রিডি ছবি। একটা সুন্দর ঝকঝকে ফ্লাইওভার ওই গর্তের ওপর দিয়ে চলে গেছে। শাঁই শাঁই করে বাস, ট্রাক, গাড়ি ছুটে যাচ্ছে সেই ফ্লাইওভার দিয়ে।

সড়কমন্ত্রী স্লাইড দেখিয়ে মধুর করে হাসলেন। বিজয়ীর হাসি।

অর্থমন্ত্রী বললেন, বাজেট কত লাগবে?

দুই হাজার কোটি টাকা হাতে পেলে শুরু করব। পাঁচ বছরে শেষ করতে না পারলে বাজেট বাড়বে, আপনি তো আছেনই।

অর্থমন্ত্রী বললেন, টাকা কি গাছে ধরে?

সড়কমন্ত্রী বললেন, বাজেট কি বেশি কম হয়ে গেছে?

অর্থমন্ত্রী বললেন, খামোশ। জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আমি দেব না।

এবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পালা। তিনিও পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন এনেছেন। তিনি পরিসংখ্যান দেখালেন, যাত্রীদের বেশির ভাগ মারা যাচ্ছে হাসপাতালে নেওয়ার পথে। যদি আহত হওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে এদের হাসপাতালে নেওয়া যেত, তাহলে ৮০ ভাগ যাত্রীরই প্রাণ রক্ষা করা সম্ভবপর ছিল।

কাজেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব হলো মাটিডাঙ্গার এই গর্তের পাশেই জমি অধিগ্রহণ করে একটা হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক।

অর্থমন্ত্রী বললেন, বাজেট দিন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, আসল খরচ জমিতে। ৩৩০ কোটি। ভবন বানাতে ২৬০ কোটি। পর্দা কিনতে দুই লাখ। বেড কিনতে দেড় লাখ। তবে রানিং ক্যাপিটাল লাগবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ওই মফস্বলে ভালো সার্জন ধরে রাখা। কাজেই কোয়ার্টার বানাতে হবে।

অর্থমন্ত্রী বললেন, টাকা কি গাছে ধরে?

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, আমার প্রকল্পটা কিন্তু সড়ক ভাইয়ের চেয়ে ঢের কম।

অর্থমন্ত্রী বললেন, না, আমি আপনাদের এই রাবিশ প্রস্তাব কিছুতেই গ্রহণ করতে পারব না। সরকারি টাকার কী বিপুল অপচয়! আর এ তো সরকারের টাকা নয়, জনগণের টাকা। আপনাদের দুজনের প্রস্তাব বোকার মতো প্রস্তাব। আমি সবচেয়ে সহজ সমাধানটা দিচ্ছি।

আমরা মাটিডাঙ্গার এই গর্তটা ভরাট করে দেব। আর যেখানে আগে থেকে হাসপাতাল আছে, তার সামনে একটা গর্ত বানিয়ে দেব। তাহলেই তো হলো?

দেখুন, কত কম টাকায় এই সমস্যার আমি কত সুন্দর সমাধান করে দিলাম।

ডিসক্লেইমার: ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই গদ্যকার্টুনের কোনো সম্পর্ক নেই।

ক্লেইমার: আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, নিহত, ক্ষতিগ্রস্ত সকলের কাছে করজোড়ে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক