কী কব আর ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউটের কথা

অলংকরণ প্রথম আলো।
অলংকরণ প্রথম আলো।

বাহে ভাষার দেশ। যার প্রসার ছিল সমগ্র উত্তরবঙ্গ, আসাম, ভুটান এবং বিহারের উত্তর-পূর্বাংশ পর্যন্ত, বলেছেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। শীর্ষবিন্দুর মতো কুড়িগ্রামে এসে মিলেছে সব কটি অঞ্চল—ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে। না বাংলা না অহম, এই কোচ-রাজবংশী ভাষাটি ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে তার ধ্বনিমাধুর্য, বাক্যবিন্যাস, শব্দগঠন, ভাব ও ভঙ্গি নিয়ে জেগে আছে। ‘তোমরা গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু রে’, এই গান এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি না জানলে তুরীয় স্বাদ নেওয়া সম্ভব নয়। সুরে একটা বিরহবেদনা অনুভব করা সম্ভব মাত্র। ‘বাপে-মায়ে বেচেয়া খাইছে, সোয়ামি পাগেলারে’, এই নারীর বেদনা একজন নাগরিক নারী কেমনে টের পাবেন?

লোকসংগীতের সুর, স্বর ও ভঙ্গি—তিনটিই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যৌথ জীবনের অভিব্যক্তি। তার প্রাণভোমরা হলো আঞ্চলিকতা। সেই অঞ্চলের গায়কি অন্য অঞ্চলের কেউ রেওয়াজ করে রপ্ত করতে অক্ষম। এমনকি রংপুর, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির সঙ্গে গোয়ালপাড়া, গৌরীপুরের ভাওয়াইয়াও ভিন্ন। এর সঙ্গে নৃকুল, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সম্পর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, লোকসংগীত রেওয়াজি নয়। দরবারি রেওয়াজ বা শহুরে রেওয়াজের সঙ্গে গ্রাম্য শিল্পীর রেওয়াজের ভেদ একেবারে ভিন্ন। শিশুর মাতৃভাষা শেখার মতো। তিনি উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গায়ক হয়ে ওঠেন। যে হাতে হাল ধরেন সেই হাতে বাঁশি। গ্রামীণ শিল্পীর গ্রহণ-বর্জনও গ্রামেই ঘটে।

মহানগর ঢাকায় না এসে যেন কারও শিল্পী হওয়ার উপায় নেই। যদি না আসেন তাহলে তিনি অচ্ছুত। হঠাৎ একজন প্রতিমা বড়ুয়া শহরে থেকে সেই অকৃত্রিম সুর ধরে রাখতে পারেন। তিনি বলতেন, ‘কলকাতাতে বসে গান করলেও যখন আমি গাই, আমার চোখের পর্দায় কিন্তু ভাসতে থাকে সেই দুরন্ত ঘরছাড়া মাহুত ফান্দী-হাতিখেদা-বনবনানী-নিশুতি বন্য পশুপাখির ডাক, কত কিছু।’

আর যাঁরা ভাওয়াইয়ার স্রষ্টা, তাঁদের চোখের সামনে সেই দৃশ্যপট না থাকলে সেই আবেগ দিয়ে তাঁরা গাইতে পারবেন না। আবেগ ধরা যায় না। অনুশীলনের বস্তুও নয়।

আসামের বুইড়া লুইত চীন থেকে আসাম হয়ে চলার পথে বিহু নামের অসমিয়া সংগীতের জন্ম দিয়েছে। তেমনি বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র হয়ে প্রবেশের পথে গড়ে তুলেছে ভাওয়াইয়া। ব্রহ্মপুত্র যেমন সমস্ত নদীকে নিজের কোলে টেনেছে, ভাওয়াইয়াও তেমনি জলপাইগুড়ি থেকে গোয়ালপাড়াকে এক সুতোয় গেঁথেছে। আর এই বিস্তীর্ণ ভূমির মাঝখানে হলো কুড়িগ্রাম। যার আকাশে-বাতাসে-বৃক্ষলতায় ভাওয়াইয়ার সুর উড়ে বেড়ায়। সংগীতের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নিয়েও এটা টের পাওয়া সম্ভব। মাঝেমধ্যে কাঁটাতার ছিঁড়ে হাতির পাল যে চলে আসে, সে কি ভাওয়াইয়ার টানে!

দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শহুরে রেওয়াজি গানের ইনস্টিটিউট হয়। কিন্তু ভাওয়াইয়া পথেই পড়ে থাকে। ভাওয়াইয়ার কথা, সুর, স্বর ও ভঙ্গি কালের যাত্রায় বিকৃত হয়। এখনকার ভাওয়াইয়াশিল্পীরা মজলিশি ঢঙে গান করেন। রংপুর-কুড়িগ্রামের কোচ-রাজবংশী ‘বাহেরা’ বাঙালি হয়ে যান। দেশভাগের কোপে কুড়িগ্রাম-চিলমারী আরও দূরে সরে যায়। নাগরিক দুরবিনে ধরা পড়ে না। অথচ একটা ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউট ইতিহাস ও সংস্কৃতি পুনর্নির্মাণে পথ দেখাতে পারে।

গৌরীপুরের বয়ান শেখ, নীলিমা বড়ুয়ার মতো ভারত অংশের শিল্পীদের বিশাল ভান্ডারের কথা বাদ দিলেও শুধু কুড়িগ্রামের এক কছিমউদ্দিনই লিখেছেন হাজার তিনেক ভাওয়াইয়া গান। এ ছাড়া আরও অন্তত কয়েক শ গীতিকার কয়েক হাজার ভাওয়াইয়া লিখেছেন। তারও আগে কয়েক শ বছর ধরে যৌথ জীবনের অংশ হিসেবে অজস্র গান লেখা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলেও কয়েকজন ইংরেজের হাতে কিছু গান সংগৃহীত হয়েছে। কখনো গীতিকারের নাম খুঁজে না পাওয়ায় কোনো কোনো বিখ্যাত শিল্পী নিজের নামে চালিয়েও দিয়েছেন। আর ভাওয়াইয়া গানে তো ভণিতা থাকে না। কে রচয়িতা, তা নিয়ে জনসাধারণের কৌতূহলও থাকে না। ইতিহাসে যখন ব্যক্তির যুগ চলে আসে, তখন যৌথ সম্পদ ব্যক্তির দখলে যেভাবে যায়। জনগণের সম্পদ জনগণের হাতে ফেরানোর পথ কী?

দুনিয়াজুড়ে লোকসংগীত আজ গবেষণার বস্তু। কারণ, এরই মধ্য দিয়ে ইতিহাসের নানান দিগন্ত খুলে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম-রংপুর অঞ্চলের জনগণ চান ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউট শিল্পী-গবেষকদের মেলা হোক। দারিদ্র্যের শীর্ষে অবস্থান করলেও সংস্কৃতিতে কুড়িগ্রাম যে উঁচু, সেটা প্রমাণিত হোক। পাকিস্তান আমলে নৌ দপ্তর যেমন নদীমাতৃক পূর্ব পাকিস্তানে হয়নি, স্বাধীন দেশে আশা রাখি ভাওয়াইয়ার দেশে ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউট হবে। ‘হাতির পিঠিত থাকিহারে মাহুত/ হাতির মায়া জানো/ নারীর মনের কথা তোমরা/ কিবা জানো রে’। কুড়িগ্রামবাসীর মনের কথা কি জানবেন?

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি
[email protected]