রোহিঙ্গাদের নিয়ে জল্পনায় সত্য কতটা?

রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিবিদ্বেষী মন্তব্যে আমরা কি মিয়ানমারকে ছাড়িয়ে যাব? প্রত্যাবাসন না বহিষ্কার কি চাইছি আমরা? ছবি: প্রথম আলো
রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিবিদ্বেষী মন্তব্যে আমরা কি মিয়ানমারকে ছাড়িয়ে যাব? প্রত্যাবাসন না বহিষ্কার কি চাইছি আমরা? ছবি: প্রথম আলো

সারা দেশে কিশোর–কিশোরীদের ‘সোজা’ রাস্তায় ফিরিয়ে আনার জন্য নানা লোক দেখানো উদ্যোগ চলছে। চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে একটি জেলা শহরের পার্ক থেকে ধরে নিয়ে আসা অসহায় কিশোরীদের সদর থানা প্রাঙ্গণে জমা করে রাখা হয়। সেই অপমানের ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার সময় সমাজের এক স্বঘোষিত বিবেক লিখেছেন ‘প্রথমে ভাবছি রোহিঙ্গারা ত্রাণের জন্য লাইন ধরেছে। ওমা! পরে দেখি...।’

রোহিঙ্গা শব্দটি এখন বাংলা ভাষায় একটি প্রচলিত গালিতে পরিণত হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশের নতুন প্রতিশব্দ এখন এটি। উত্তরের খেটে খাওয়া মানুষদের যেমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অনেকে মফিজ বলে থাকে! রোহিঙ্গা শব্দের মধ্যে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্যের ভাব মফিজের চেয়েও প্রখর ও গভীর। রিকশা চালিয়ে দিনগুজরান করেন এমন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের সঙ্গে দেনা–পাওনার দর–কষাকষিতে পড়তা না পড়লে তাকে রোহিঙ্গা বলে মনের আক্ষেপ মেটাচ্ছি। অফিসের অপছন্দের সহকর্মীর মর্মে আঘাত দেওয়ার এখন মোক্ষম শব্দ ‘তুই রোহিঙ্গা’ বা ডাকছি ‘এই রোহিঙ্গা’ বলে। হাসি–ঠাট্টা–গুলতানিতেও বন্ধুকে হেলাফেলার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রোহিঙ্গা’ এখন শীর্ষে।

দ্বিতীয় দফার শরণার্থীদের পাঠানোর চেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার সঙ্গে আমাদের এই শব্দ চয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সেটা যে আমাদের মনের মধ্যে পুষে রাখা আগুনে চর্বি ঢেলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা (উখিয়া উপজেলার চেয়ারম্যানসহ অনেকে অবশ্য এই প্রচেষ্টাকে স্রেফ ‘নাটক’ বলেছেন) ভেস্তে যাওয়ার পর সরকার–অসরকার, কবি–অকবি, টক শো তারকা, ফেসবুক মাফিয়া, গণমাধ্যম–ব্যক্তিমাধ্যম সবাই যেন একযোগে একতরফা বাগ্‌যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এ বাগ্‌যুদ্ধ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। তাদের যেকোনোভাবে ঝেঁটিয়ে বিদায়ের পক্ষে। এসব একতরফা বাগ্‌যুদ্ধ বা নেতিবাচক প্রচারণা ধাপে ধাপে জনউন্মাদনা (হিসটেরিয়া) উসকে দিয়ে মারমুখী ‘রোহিঙ্গা খেদাও’ আন্দোলনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা এখন আর একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্রিটিশ ভারতে আর দেশভাগের পর আসামে এ রকম ঘৃণা ছড়িয়ে সহিংস বাঙালি খেদাও আন্দোলনের কদর্য ক্ষত আমরা দেখেছি। তখন মোবাইল–ফেসবুক ছিল না। তারপরও ঘৃণা ছড়িয়েছিল দাবানলের মতো। আর এখন ফেসবুক সভ্যতার (নাকি অসভ্যতা) যুগে ঘৃণাকে সহিংসতায় রুপ দিতে সময় লাগে না। রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুরের দগদগে ঘা কখনো শুকানোর নয়।

গত আগস্ট ২০১৭ তে যখন নির্যাতনের মুখে হিন্দু–মুসলিমনির্বিশেষে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালাতে শুরু করে, সে সময় ফেসবুকে রোহিঙ্গাবিরোধী একটি গ্রুপের সদস্যদের পোস্টিং ২০০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। ফেসবুকের ওই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৫৫ হাজার। গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়ার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিংয়ের গবেষক অ্যালান ডেভিস দুই বছর ধরে মিয়ানমারে কট্টর বৌদ্ধ নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের আগের বেশ কিছু দিনে তিনি দেখেছেন কীভাবে ফেসবুকে পোস্টগুলো ‘অনেক বেশি সংগঠিত, ঘৃণা-মিশ্রিত এবং জঙ্গি’ হয়ে উঠছে।

উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য–মনোভাব ক্রমশই বার্মার সামরিকজান্তাদের মতো হয়ে যাচ্ছে, আমরা আর আমাদের নোংরা মনটা সাধুর লেবাসে ঢেকে রাখতে পারছি না। আমাদের গায়ের রংটা যদি একটু পীত হতো তাহলে রোহিঙ্গাদের আমরা ‘কালাই’ বলতাম যেমন বলে বার্মিজ আর্মি, হিংসাবাদী বৌদ্ধ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা।

শরণার্থীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত নানা ধারণা আর কানকথাকে পুঁজি করে এ দেশেও এখন চলছে ঘৃণা প্রচারণা। মোটা দাগের যেসব অভিযোগ শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে করা হচ্ছে সেগুলো একটু যাচাই করে দেখা যাক।

ক. অতিরিক্ত সন্তান জন্ম দেয়, পরিবার পরিকল্পনার ধার ধারে না
আমাদের মনে রাখতে হবে সস্প্রসারিত টিকা কর্মসূচি, কলেরা, ম্যালেরিয়া দূরীকরণ কর্মসূচির সাফল্য, ঘরে বসে ডায়রিয়া চিকিৎসার ব্যবস্থা উদ্ভাবন ইত্যাদি কারণে কম সন্তান গ্রহণের যে প্রবণতা আজ আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে, তা মিয়ানমারের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর কাছে স্বপ্নেরও বাইরে। তারপরও প্রতি পরিবারে দশ–বারোজন সন্তানের যে ঢালাও বর্ণনা দেওয়া হয় সেটা ঠিক নয়। গড়ে পাঁচ থেকে ছয়টির বেশি সন্তান খুব বেশি পরিবারে দেখা যায় না। আমাদের উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চল এবং চর অঞ্চলের জন্ম হারের সঙ্গে এটা মিলে যায়।

সপ্তাহ কয়েক আগে এই ধারণার জবাব দিতে গিয়ে লেখক আলতাফ পারভেজ আমাদের (বাঙালি সমাজের) পরিবারের আয়তন এবং আমাদের পিতা–মাতাদের ও তাঁদের বাবা–মায়ের সন্তান সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন: ‘...অপরের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে মন্তব্য করা অশোভনই মনে হয়। কিন্তু বাঙালি বন্ধুরা যেভাবে রোহিঙ্গাদের সন্তান, বিয়ে ইত্যাদি নিয়ে প্রতিনিয়ত খোঁজখবর-বিবরণ দিচ্ছেন, তা দেখতে দেখতে শেষ পর্যন্ত বিখ্যাত বাঙালিদের পারিবারিক ব্যাপারে খোঁজ নিতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। স্বভাবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই তল্লাশি শুরু করেছি। দেখলাম তিনি সারদাসুন্দরী দেবী ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৌদ্দতম সন্তান। তাঁর নিজেরও পাঁচ সন্তান।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িকে আমরা আধুনিকতার একটা ভরকেন্দ্র হিসেবেই মানি।
বাঙালি অপর দুই নোবেল বিজয়ীর মধ্য অর্মত্য সেনের সন্তান চার এবং সব মিলে তিন বিয়ে করেছেন তিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। তাঁরও একাধিক বিয়ে। কবি কাজী নজরুল ইসলামও মায়ের ষষ্ঠ সন্তান। তাঁর নিজের সন্তান চার। তাঁরও একাধিক বিয়ে।
রাজনীতিবিদদের মধ্যে মাওলানা ভাসানীর দুই ‘পরিবার’-এ সন্তান আটজন বলে তথ্য পাচ্ছি। তাঁরও তিন বিয়ে।...অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশিষ্টজনদের তথ্যই কমবেশি এ রকম। বুঝতে পারছি না, পরিবারের সাইজ বিষয়ে বাংলাদেশিদের ‘আইকন’ কে? তাদের ‘ঐতিহ্য’-এর সঙ্গে বক্তব্য-হিংসা-বিদ্বেষ-প্রত্যাশার কোনো সাযুজ্য থাকছে না!

খ. মাদক চোরাচালান ব্যবসায় লিপ্ত
শরণার্থীদের ঢল নামার অনেক আগে থেকে এই অঞ্চল মাদক চোরাকারবারের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। চোরাকারবারিদের ও তাদের পৃষ্টপোষকদের তালিকা সরকারের কাছে হালনাগাদ অবস্থায় আছে। সরকার সব সময় মাদক ব্যবসার শিকড় উপড়ে ফেলার অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ। চেষ্টাও অব্যাহত আছে। শক্ত স্থানীয় সহযোগিতা না পেলে ছিন্নমূল শরণার্থীদের পক্ষে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হওয়া সহজ নয়। শিকড়ে হাত না দিয়ে তাহলে আমরা ওপর–ওপর কথা বলছি কেন?

গ. মোবাইল ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বেপরোয়া হয়ে উঠছে
প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার দুই বছর পূর্তির সফল সমাবেশের পর শরণার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের সহজ পথ বন্ধ করার জন্য এই প্রচার। শরণার্থীদের সংঘবদ্ধ হওয়াটা অনেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত শফিউল্লাহর মতে, বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিবেচনা করতে পারি। তাঁদের নেতাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ এবং প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে গঠনমূলক ও টেকসই সমাধানের একটা হাতিয়ার হতে পারে এই প্রক্রিয়া। সমাবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা, তা মোটেও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির অশনি সংকেত নয় বলে তিনি মনে করেন।

জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। যাদের মধ্যে ব্যবহার হচ্ছে ৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি মোবাইল অপারেটরের সিম। বাংলাদেশের সিম ব্যবহার মংদু লেংদুবাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। মিয়ানমার বা বাংলাদেশের বাইরে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের এটাই একমাত্র মাধ্যম। চলতি মাসের শুরুতে ক্যাম্পগুলোতে নেটওয়ার্ক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। তবে টেকনাফ ও উখিয়ায় স্থানীয়দের কথা বিবেচনা করে পরে শুধু ক্যাম্প এলাকায় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থ্রি–জি ও ফোর–জি সেবা বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট যোগাযোগে বিধিনিষেধের কারণে জটিল ত্রাণ ও জরুরি সেবা বাধাগ্রস্ত হবে। হচ্ছেও। বিকেলের আগেই ক্যাম্প থেকে ত্রাণকর্মীদের চলে আসার নিয়মের কারণে ক্যাম্পে যেসব জরুরি সেবা ব্যবস্থা ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়, মোবাইল ছাড়া সেসব সেবা দেওয়া অসম্ভব।

ঘ. অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে
অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার প্রমাণ দেখাতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের লেজে আবারও গোবর লেগেছে। স্থানীয় মানুষের জন্য তৈরি ও বিতরণের অপেক্ষায় রাখা কৃষি যন্ত্রপাতি নিড়ানি, দা, কোদাল ইত্যাদিকে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা চলেছিল, তা শেষ পর্যন্ত হালে পানি না পেলেও প্রচার পেয়েছিল যথেষ্ট। তারপরও অপপ্রচার বন্ধ নেই।

আমরা সবাই চাই শরণার্থীরা নিজ দেশে শান্তির সঙ্গে ফেরত যাক। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের আলোকে এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হোক। আবার ফেরত আসার ফাঁক রেখে তাদের জোর করে ফেরত পাঠানোর মধ্যে কোনো টেকসই সমাধানের হদিস নেই।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]