নতুন ভ্যাট আইন কতটা ডিজিটাল

নতুন ভ্যাট আইন ২০১২ সালে পাস হওয়ার দীর্ঘ সাত বছর পর গত ১ জুলাই থেকে মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই আইন বাস্তবায়নের শুরুতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা ও তাঁদের অংশগ্রহণে বাজেট অধিবেশনের মাধ্যমে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলো অনেকাংশে দূর করা হয়েছে।

নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আগে ব্যবসায়ীদের অন্যতম দাবি ছিল একাধিক ভ্যাটের হার নির্ধারণ, ভ্যাটের অব্যাহতির সীমা বৃদ্ধি করা, মূল্য ঘোষণা পরিহার করা, উপকরণ করের রেয়াত সম্প্রসারিত করা এবং চলতি হিসাব বাতিল করা। তাঁদের দাবির কিছু জায়গা ভ্যাটের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে।

১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের তুলনায় ২০১২ সালের আইনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হলেও নতুন আইনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হচ্ছে এর প্রযুক্তিনির্ভরতা। ভ্যাটসংশ্লিষ্টদের অনেকে মনে করেন, নতুন আইনটির সফলতা পুরোটাই নির্ভর করছে এই প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনার ওপর। ইতিমধ্যে
এর পেছনে কাজ করছে ‘ভ্যাট অনলাইন’ নামের একটি বড় প্রকল্প। ২০১২ সালের আইন পাস হওয়ার পরপরই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। নতুন আইন বাস্তবায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে ও সংশ্লিষ্ট নানা অবকাঠামো এবং সুবিধাদি প্রদান করে যাচ্ছে এই প্রকল্প।

ইতিমধ্যে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ২২টি মডিউল প্রণয়ন করেছে ভ্যাট অনলাইন। এদের প্রধান চারটি হচ্ছে ভ্যাটদাতা ব্যবসায়ীদের জন্য। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন। একজন ব্যবসায়ী বা তাঁর পক্ষে মনোনীত যে কেউ অনলাইনে যেকোনো প্রান্ত থেকে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন দাখিল করতে পারবেন। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে (ক্ষেত্রবিশেষে যাচাই সাপেক্ষে) তিনি ফিরতি ই-মেইলে অনুমোদিত রেজিস্ট্রেশন নম্বর পেয়ে যাচ্ছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য টেন্ডার, পণ্য খালাসসহ নানা কাজে স্বল্প সময়ে এই রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় তিনি ভ্যাট অফিসে যাওয়ার বিড়ম্বনা এড়াতে চান। নতুন আইন অনুসারে নতুন ও পুরোনো সবাইকে ১৩ ডিজিটের রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে। মাঠপর্যায়ের অফিসগুলো বিপুলসংখ্যক রেজিস্ট্রেশনের এই সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এই মডিউলের এখনো কিছু কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে। ধীরগতি, প্রায়ই আটকে যাওয়াসহ আরও কিছু সমস্যার কথা এখনো পাওয়া যাচ্ছে। তবে এটা নতুন ব্যবস্থায় উত্তরণের সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর সমাধান নিয়ে সংশ্লিষ্ট টিম কাজ করছে।

নতুন আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল। প্রতি মাসে ক্রয়-বিক্রয়, রিফান্ড, প্রত্যর্পণ এবং ভ্যাট জমা দেওয়ার হিসাব জমা দিতে হবে এই রিটার্নে। আইনের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী প্রতি মাসের রিটার্ন পরের মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে দাখিল করতে হবে। আগের আইনে আলাদাভাবে এসব ক্রয়, বিক্রয়, চলতি হিসাব ইত্যাদির রেজিস্টারপত্র সনাতন পদ্ধতিতে রাখা ও তা সংরক্ষণ করা হতো। এখন এসব কাজ অনলাইনে রিটার্নের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাবে। যেকোনো ভ্যাটসংশ্লিষ্ট হিসাবের আবেদন নিষ্পত্তিও এই রিটার্নের মাধ্যমে হবে। আইনে বর্ণিত ভ্যাট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপও এই রিটার্নের ওপর নির্ভর করে হতে পারে। এই মডিউল বর্তমানে প্রস্তুত এবং এখন যেকোনো নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান সিস্টেমে লগইন করে পূর্ববর্তী মাসের রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।

আগের আইনে ভ্যাট প্রতিষ্ঠানকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ভ্যাট জমা দিতে হতো। এতে অনেককে ব্যাংকে যাওয়া এবং লাইনে দাঁড়ানোর ভোগান্তি পোহাতে হতো। অন্যদিকে ভুয়া ট্রেজারি চালান প্রদর্শনের মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকির আশঙ্কাও ছিল। এমন অনেক মামলার তথ্য রয়েছে ভ্যাট কর্তৃপক্ষের কাছে। এর থেকে পরিত্রাণের নিমিত্ত নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় যুক্ত হচ্ছে ইলেট্রনিক পদ্ধতিতে (ই-পেমেন্ট) ভ্যাট জমা দেওয়ার বিশেষ মডিউল। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের নিজের ব্যাংক হিসাব অথবা অন্য যেকোনো ক্রেডিট হিসাব থেকে এবং নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো পরিমাণ টাকা ভ্যাট হিসেবে জমা করতে পারবেন। ভ্যাট কর্তৃপক্ষসহ যে কেউ এই জমাকৃত ভ্যাটের সত্যতা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করে নিতে পারবেন এবং রাজস্বের হিসাবে দেখাতে পারবেন। এতে রাজস্ব পরিসংখ্যানের গরমিল কমে যাবে। 

রিফান্ড আবেদন ও প্রাপ্তির সুবিধাসংক্রান্ত আরেকটি মডিউলও চালুর উদ্যোগ আছে। ঘরে বা অফিসে বসে প্রতিষ্ঠান বা তার পক্ষে মনোনীত যে কেউ আবেদন করলে অতিরিক্ত জমাকৃত বা অন্য কোনো কারণে ফেরতের আবেদন করলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করে অনুমোদন হবে। একই সঙ্গে মঞ্জুরকৃত টাকাও আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে চলে যাবে। আবেদনকারীকে এখন আর ভ্যাট অফিসে যেতে হবে না। টেবিলে টেবিলে নথি নিয়ে ঘুরতে হবে না। শেষের দুটো মডিউল এই অর্থবছরের মধ্যেই হবে মর্মে জানা গেছে।

অন্যদিকে বাকি ১৮টি মডিউল ভ্যাট কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অডিটিং, পরিদর্শন, তথ্য ব্যবস্থাপনা, বিক্রয় যাচাইসহ অন্যান্য তদারকিতে সহায়ক হবে। বর্তমানে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প এসব মডিউল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই এগুলো ভ্যাট কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করবে। এর ফলে ভ্যাট আহরণে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।

একই সঙ্গে ভ্যাটসংক্রান্ত ক্রেতার যেকোনো প্রশ্ন ও তথ্য জানতে চালু হয়েছে ১৬৫৫৫ কল সেন্টার। এই নম্বরে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ভ্যাটসংক্রান্ত যেকোনো সেবা গ্রহণ বা তথ্য পাওয়া যাবে। এই নম্বর ব্যবহার করে অভিযোগ দায়ের ও প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকবে। নতুন ভ্যাট ব্যবস্থার আরেকটি দিক হলো, যেসব ভ্যাট প্রতিষ্ঠানের মাসের গড় বিক্রি পাঁচ কোটি বা তার ওপরে, তাদের জন্য এনবিআর কর্তৃক বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভ্যাটের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান তার ক্রয়, বিক্রয়, স্টক ও পেমেন্টের হিসাব সংরক্ষিত থাকবে। এতে সফটওয়্যারের নিজস্ব নিরাপত্তা যুক্ত করা হয়েছে এবং এর তথ্যাদি যাচাই করার সুযোগ থাকছে। এই সফটওয়্যার ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হওয়ার কথা রয়েছে এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠান এর আওতায় চলে আসবে। ফলে প্রতিষ্ঠানের উপকরণ, উৎপাদন, স্টক, বিক্রি, ভ্যাট পরিশোধ ইত্যাদিসংক্রান্ত যাবতীয় হিসাব ও লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

নতুন ভ্যাট আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) নামের নতুন যন্ত্র স্থাপন করা। এই ডিভাইস আগের ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রারের (ইসিআর) স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে। এনবিআর প্রথম পর্যায়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ক্যাটরার্স, বিউটি পারলার, স্বর্ণকার, খুচরা ব্যবসায়ী, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ ২৪ ধরনের প্রতিষ্ঠানে এই ইএফডি ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করেছে। ইতিমধ্যে ১০ হাজার যন্ত্র ক্রয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের প্রযোজ্য সব প্রতিষ্ঠানে এই যন্ত্র সরবরাহ করা হবে। এর অন্যতম সুবিধা হলো, এই যন্ত্রে যেকোনো লেনদেন এনবিআরের কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে কেউ ইচ্ছা করলেও কোনো বিক্রয় বা ভ্যাটের টাকা গোপন বা লুকাতে পারবেন না।

এসব ডিজিটাল সুবিধাদি বর্তমান ভ্যাট আইনের অন্যতম সংযোজন, যা আরও বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ফলে কম সময়ে ও কম খরচে ভ্যাটের সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে প্রযুক্তিনির্ভর ভ্যাটের হিসাবে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে। জনগণের দেওয়া ভ্যাট ফাঁকির সুযোগ ও ব্যবসায়ীদের হয়রানির অভিযোগ দুটোই সংকুচিত হবে। সঠিক পরিমাণ ভ্যাট রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের অগ্রগতি আসবে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিযোগিতামূলক ও ইতিবাচক সচলতা সৃষ্টি হবে।

(লেখকের ব্যক্তিগত মতামত)


ড. মইনুল খান কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাটের (ঢাকা পশ্চিম) কমিশনার