বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি উপাচার্যদের স্বেচ্ছাচারী বানানো?

সঠিক প্রশ্ন অন্যায়কারীর মনে জ্বালা ধরায়। এটাই তার শক্তি। কতটা জ্বালা ধরায় তার উদাহরণ হয়েছেন দুই উপাচার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে প্রথম আলো ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরা একটা প্রশ্ন করেন। উন্নয়ন প্রকল্পের দুই কোটি টাকা ছাত্রলীগের মধ্যে বণ্টনের ঘটনা সত্য কি না? বলামাত্রই উপাচার্য ‘এমন প্রশ্ন করার সাহস কোথায় পেলো’ বলে হুংকার ছাড়েন এবং দুজনের বিরুদ্ধেই শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেন। এদিকে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরও এগিয়ে। ফাতেমা–তুজ–জিনিয়া নামের এক ছাত্রী উপাচার্যকে প্রশ্ন করেছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’ উপাচার্য যা পারেন তা–ই করেছেন। ছাত্রীটিকে বহিষ্কার করে মুশকিল আসান ভেবেছেন। এদিকে ফেসবুকের দেয়াললিখন কে খণ্ডাবে? সবাই প্রশ্ন করছে: বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? আসলে জানতে চাইছে উপাচার্যদের কাজ কী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ কী? দুর্নীতির টাকা বণ্টন করা আর প্রতিবাদকারীদের শাস্তি দেয়া?

রূপকথায় দেখি, সত্য বললে দৈত্য মরে যায়। আর দৈত্যের প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে তাকে খেয়ে ফেলে দৈত্য। গ্রিক উপকথার দৈত্য স্ফিংস থিবিস নগরের ফটকে বসে থাকতো একটা ধাঁধা নিয়ে। নগরে ঢুকতে হলে ঔ ধাঁধার উত্তর দিতে হতো। কেউ তা পারছিল না। এর মধ্যে হাজির হলো বীর অয়দিপাউস। স্ফিংসের ধাঁধার উত্তর বলা মাত্রই ঘটলো সর্বনাশ। দৈত্যের ক্ষমতা উবে গেল, তার পরাজয় ঘটলো।

সঠিক উত্তরের মতোই সঠিক প্রশ্ন যে কত শক্তিশালী তা দুই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা দুটি জাতীয় গুরুত্ববহ প্রশ্ন তা বুঝিয়ে দিল।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’ এই জরুরি কিন্তু প্রাথমিক প্রশ্নটাকেই বশেবিমুপ্রবি উপাচার্য কেন ভয় পেলেন? এতই ভয় যে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের’ অভিযোগ তুলে জিনিয়াকে বহিষ্কার করে দিলেন! প্রশ্নকারীর মধ্যে কী বিপদটাই না তিনি দেখতে পেয়েছেন। অতীতেও প্রশ্ন–অভিযোগ ইত্যাদি করায় ছয়জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে তাঁর প্রশাসন।

আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রধান গর্ব এই যে, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ টাকায় চা, শিঙাড়া, চপ পাওয়া যায়; তিনিও কি জানেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? জানলে কীভাবে চিরকুট দিয়ে ছাত্রনেতাকে শুধু ভর্তিই করান না, তাদের আবার ডাকসুতে নির্বাচিত করিয়েও আনেন!

সঠিক প্রশ্নে কতটা ভীত হয়ে পড়ে প্রশাসন? জাবিতে পরিবেশ ধ্বংস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছয় শিক্ষকের মোবাইলের সিম ব্লক করা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।  অর্থাৎ তাঁরা যেন কথা বলতে না পারেন, তাঁরা যাতে প্রশ্ন তুলতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করেছে কেউ। তাঁদের মধ্যে আছেন অর্থনীতিবিদ আমীর হোসেন। আছেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারের শিক্ষক লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক রায়হান রাইন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, একই বিভাগের অধ্যাপক তারেক রেজা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন। তাঁরা শিক্ষক হিসেবে গুণী, নিষ্ঠাবান ও দায়বদ্ধ। রায়হান রাইন পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও ঔপন্যাসিকই শুধু নন, তিনি নিরলসভাবে বাংলার দর্শনের ইতিহাস ও পরিচয় নিয়ে গভীর ও পরিশ্রমী গ্রন্থ রচনা করে যাচ্ছেন। ভাল শিক্ষক, ভাল লেখক, ভাল পন্ডিত প্রতিবাদী হলেই বিপদ। ড. সাঈদ ফেরদৌস সেই বিরল শিক্ষকদের একজন, যাঁরা ক্লাসরুমে ও গবেষণায় সমানভাবে সক্রিয়। অধ্যাপক তারেক রেজা লেখক ও কবি, অধ্যাপক জামাল উদ্দিন একাডেমিক মানুষ। তাঁরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রশ্নের শক্তি কতটা, তা জাহাঙ্গীরনগর কাণ্ডের উন্মোচনের মধ্যেই প্রমাণিত।

দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও চলছে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র এবং নিয়ন্ত্রণহীন দলীয়কৃত লুটপাট। এর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না? উচ্চশিক্ষার ধ্বংস সয়ে যেতে হবে? যেখানে গবেষণায় টাকা পাওয়া যায় না, শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার দেওয়া যায় না, সেখানে শত–হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন চলে কিসের স্বার্থে? সেই টাকার ভাগ–বাঁটোয়ারা ফাঁস হয়েছে বলে শোরগোল হচ্ছে। ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই জানেন, যতটা ফাঁস হয় তা আদতে হিমশৈলের চূড়ামাত্র—তলায় আরও অনেক কিছু আছে; আছে আরও আরও উপাচার্য ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের নাম।

বাঁচতে হলে তাই জানতে হবে। জানার জন্য প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্নের স্বাধীনতা যদি বিশ্ববিদ্যালয় দিতে না পারে, সেটাকে আর বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। সেটা হয়তো ছাত্রছাত্রীদের খোঁয়াড়, উন্নয়নের ভাগাড় আর স্বেচ্ছাচারী উপাচার্যদের বাগানবাড়ি। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা, অভিভাবকেরা কি এই অবস্থা মেনে নিতে পারেন? যে বঙ্গবন্ধু আজীবন ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে গেছেন, ছাত্র অবস্থায় সেজন্য বহিষ্কৃতও হয়েছেন, সেই বঙ্গবন্ধুর গোপালগঞ্জে এমন উপাচার্য কীভাবে রাজত্ব করেন? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স প্রায় বাংলাদেশের বয়সের সমান। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায় সম্পদ ও পরিবেশ উপাচার্য এবং তাঁদের সমর্থকদের পারিবারিক বিত্তবিলাসের খোরাক আর কত জুগিয়ে যাবে? অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও জাহাঙ্গীরনগরের মতো অনিয়ম–দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকী। তা–ই যদি হয়, তাহলে কেন এসব নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত ও শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে না?

জিনিয়া নামের ছাত্রীটির প্রশ্নটিকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী উপাচার্যদের জমিদার বানানো?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]