পিছলা খাওয়া মেয়র ও পিছলে পড়া নগরবাসী

.
.

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযানে নেমেছিলেন ঢাকার দুই মেয়র। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁদের এই অভিযানের ফাঁক দিয়েই ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। তারকা শিল্পী–খচিত মশকনিধন অভিযান কিংবা ফগার মেশিন-ঝাড়ু-শাবল-কোদালে সজ্জিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শোডাউন কোনো কিছুই মশাদের দমাতে পারেনি সেভাবে। অদম্য এই মশার দল কী অসীম সাহসী আর শক্তিশালী! ডেঙ্গু মশার বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সগর্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরা, কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। মশারা নাকি আজকাল সর্বংসহা হয়ে উঠেছে। কোনো মশার ওষুধ সেভাবে কাজ করছে না মশাদের ওপর। তবে এসব ওষুধ আসল, নাকি ভেজাল, সে বিতর্কে আজ আর না যাই।

আমরা দেশবাসীই যখন ভেজাল খাবার এবং ওষুধের ভিড়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তখন আসল মশার ওষুধের আশা করাই একধরনের বোকামি। আবার কখনো মনে হয়, এই মশারা হয়তো অতিশয় নির্বোধ। নির্বোধ বলে এরা মেয়র চেনে না, চেনে না তারকা শিল্পী কিংবা নামীদামি খেলোয়াড়। ডেঙ্গু রোগ বিস্তারকারী এডিস মশারা মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মশাবিরোধী অভিযান এবং আয়োজন দেখেশুনে কতখানি ভয় পেয়েছে, তা বলা মুশকিল; তবে এডিস মশা নিধন করতে মেয়ররা যে ধরাশায়ী হয়েছেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সম্প্রতি দেশবাসী জেনেছেন, মশকনিধন কর্মতৎপরতায় নাকি ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে ফেলেছেন। অন্যদিকে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন সিঙ্গাপুর গিয়ে দেখে এসেছেন মশকনিধনের আধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতি। এ ছাড়া কর্মকর্তারা বিশ্বের নানা প্রান্তে জ্ঞানলাভ করছেন, কীভাবে এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার উৎপাদন বন্ধ করা যায়, সেসব বিষয়ে।

সম্প্রতি ডেঙ্গু বিস্তারের মাত্রা সামান্য কমলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসতে এখনো সময় লাগবে। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে, বাংলাদেশে শুধু ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট রোগীর ৫৬ শতাংশই ঢাকার। চলতি বছর প্রায় আড়াই শ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে ডেঙ্গু রোগে। কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় প্রকাশ করা হয়েছে, এ বছর ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। তবে আশার কথা, সরকার, সিটি ও পৌর করপোরেশনের তৎপরতা, পাশাপাশি সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে ডেঙ্গু পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ঋতুর পরিবর্তনও ডেঙ্গুর ব্যাপকতা কমাতে ভূমিকা রাখছে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এক মাঘে যেমন শীত যায় না, ঠিক তেমনি ডেঙ্গু মশাদের সাম্রাজ্যও এক বছরে শেষ হয়ে যাবে না।

মশার আধিপত্য বাংলাদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। ডেঙ্গুর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া কিংবা ফাইলেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের সঙ্গে এ দেশের মানুষ বহু আগে থেকেই পরিচিত। আজ এডিস মশার বিষয়টি নতুনভাবে আলোচিত হলেও অ্যানোফিলিস কিংবা কিউলেক্স মশার উপদ্রবের কথা আমরা সবাই জানি। এসব মশা দমনে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু মশারা দিন দিন কেবল পরাক্রমশালীই হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, মশাদের দিন দিন পরাক্রমশালী করার নেপথ্যে যেসব কুশীলব রয়েছেন, তাঁরা বছরের পর বছর পর্দার অন্তরালেই রয়ে গেছেন। এসব কুশীলবকে পর্দার বাইরে আনার জন্য কেউ কি কখনো অভিযান চালিয়েছেন? এই কুশীলবরা কিন্তু ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া কিংবা চিকুনগুনিয়া রোগ বিস্তারকারী মশার চেয়ে হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী!

সম্প্রতি চারটি বিভাগে মশা জরিপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। এই জরিপ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক অর্থবল ও জনবল। মশা নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে নাকি এই জরিপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই জরিপ মশা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের। আশা করি, সততার সঙ্গে জরিপটি পরিচালিত হবে। তবে এর পাশাপাশি প্রয়োজন যাঁদের দুর্নীতির কারণে আজ দেশে মশা নিয়ে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও জরিপ পরিচালনা করা। তাঁদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। মশার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা, এমনকি মেয়ররা নগরবাসীর বাসাবাড়িতে খুঁজে পাচ্ছেন লার্ভা; তাঁরা নগরবাসীকে জরিমানাও করছেন। অথচ তাঁদের চেনা পরিসরে যত্নে-আদরে মশার লালন–পালনকারী যেসব দুর্নীতিবাজ বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা তাঁদের দেখতে পাচ্ছেন না। এঁদের চিহ্নিত করতে না পারলে মেয়ররা বারবারই পিছলা খাবেন; তাঁদের মশকনিধন প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না; কাজে আসবে না তাঁদের ভ্রমণলব্ধ বহু মূল্যবান জ্ঞান। আর আমরা নগরবাসী তো সেই কবে থেকেই পিছলা খেয়ে পড়ে আছি। এই পিচ্ছিল ফাঁদ থেকে নগরবাসীকে উদ্ধার করবে কে?

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]