বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের শিক্ষা

ইসলাম সমগ্র মানবজাতিকে একই পরিবারভুক্ত মনে করে। ইসলামের দাবি হচ্ছে, সব মানুষই এক আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি এবং তিনি সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি প্রত্যেক মানুষকেই মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টির সেরা করেছেন।

ব্যক্তিমানুষের সম্মানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংরক্ষণ করে ইসলাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা-৯৪ তিন, আয়াত: ৫)

সব মানুষ ভাই ভাই, কারণ সবাই একই পিতা–মাতার সন্তান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর এতদুভয় থেকে বহু নর ও নারী সম্প্রসারণ করেছেন।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১)

ইসলামে ভৌগোলিক, আঞ্চলিক, নৃতাত্ত্বিক, জাতিগত ও ধর্মীয় প্রভেদে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সমর্থন করে না। ইসলামে কোনো প্রকার শ্রেণিবৈষম্য নেই, কোনো অস্পৃশ্যতাও নেই। ইমান আনা না–আনার বিষয়টি মানুষের বিবেক–বুদ্ধি ও ইচ্ছার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘দ্বীন সম্পর্কে জোরজবরদস্তি নেই; সত্য ভ্রান্তি থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে, আল্লাহে ইমান আনবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)

ইসলাম মানুষকে জাতি ও বর্ণ দিয়ে বিচার করে না। বরং তার বিশ্বাস ও কর্মের মূল্যায়ন করে। বিশ্বাস মানুষের অন্তরের বিষয়। কর্মে তা কখনো প্রকাশ পায়, আবার কখনো প্রকাশ পায় না। বিশ্বাস গড়ে ওঠে জ্ঞানের আলোয়। বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এ জন্যই যার যার বিশ্বাস তার তার। তাই কারও বিশ্বাস নিয়ে বিদ্রূপ, কটূক্তি বা কটাক্ষ করা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ; গালমন্দ ইসলামে হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা আল্লাহ ছাড়া যেসবকে ডাকে, তোমরা তাদের গালি দিয়ো না; ফলে তারা আল্লাহকে গালি দেবে শত্রুতাবশত অজ্ঞতার সঙ্গে। (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১০৮)

বিচার ফয়সালার ভার আল্লাহর হাতে। এ প্রসঙ্গে কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা মুমিন আর যারা ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ছাবিইন; তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে তবে তাদের জন্য তাদের রবের নিকট বিনিময় রয়েছে’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৬২)। ‘নিশ্চয় যারা মুমিন আর যারা ইহুদি, ছাবিইন, খ্রিষ্টান ও মাজুস এবং মুশরিক; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ১৭) ‘অবশ্যই আপনি বিশ্বাসী মুমিনদের ভালোবাসা ও সম্প্রীতিতে নিকটতম পাবেন তাদের, যারা বলে আমরা নাসারা (সাহায্যকারী) খ্রিষ্টান।’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৮২)

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা আসো সে বাণীর দিকে, যা তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সামঞ্জস্যশীল; আমরা আল্লাহ ছাড়া কারও আনুগত্য করব না, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করব না, আল্লাহ ভিন্ন আমাদের কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব না; যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তোমরা সাক্ষ্য দাও নিশ্চয় আমরা অনুগত মুসলিম।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪)

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তারা ইবাদত করুক এই গৃহের মালিকের, যিনি তাদিগকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হইতে তাদিগকে নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা-১০৬ কুরাইশ, আয়াত: ৩-৪) অর্থাৎ, তাদের উচিত বায়তুল্লাহ তথা কাবা শরিফের রবের ইবাদত–বন্দেগি করা, যিনি ক্ষুধা ও ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা বিধান করেছেন। এতে বোঝা যায়, ইসলামি আদর্শই মানুষের মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকারের একমাত্র রক্ষাকবচ।

মানুষ দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে চায় সব ধরনের ভয়ভীতি থেকে তার জানমাল, ইজ্জত আবরুর হেফাজতের নিশ্চয়তা। ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রতিটি দিক ও বিভাগেই রয়েছে মানুষের সব অধিকারের বাস্তব প্রতিফলন। নবী–রাসুলের আগমনও আসমানি কিতাবের মূল লক্ষ্য মানুষের সমাজে প্রকৃত শান্তি কল্যাণ এবং ইনসাফ নিশ্চিত করা। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর আগমন এবং সর্বশেষ কিতাব আল–কোরআন নাজিলের চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সব বিশ্বাসী মানুষ এক দেহসম। দেহের যেকোনো জায়গায় ব্যথা পেলে চোখে পানি আসে, সারা শরীরে জ্বর আসে’ (বুখারি ও মুসলিম)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com