জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির চোখে বাংলাদেশ - ৩

>

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে (ক্যাট) বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় গত ৩০ ও ৩১ জুলাই। সেখানে গুম, আটক, হেফাজতে নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অভিযোগ তোলে কমিটি এবং এর জবাব দেয় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। এরপর ৯ আগস্ট নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও কিছু বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ এবং সঙ্গে বিভিন্ন সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে কমিটি। সেই প্রতিবেদনের ১ম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে গতকাল। এখানে থাকছে ৩য় পর্ব। ২য় ৪র্থ পর্ব লিংকে।

ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহার
নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহারের ঘটনার নিয়মিত অভিযোগসমূহের বিষয়ে কমিটি খুবই উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে কাছে থেকে হাঁটু, পা বা কনুইয়ে গুলি করার অনুশীলন চালানো, যা ‘নিক্যাপিং’ নামে পরিচিত, যেগুলো প্রায়ই অঙ্গহানিসহ স্থায়ী প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি করে থাকে। সাম্প্রতিক ও অতীতের নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনায় কর্তৃপক্ষের ঘটানো নানা সহিংসতার বিষয়ে পাওয়া প্রতিবেদনের ব্যাপারেও কমিটি উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে আছে বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হামলা, পোলিং স্টেশন জব্দ করা এবং হুমকি দিয়ে ও সহিংসতার মাধ্যমে ভোট দমিয়ে রাখা (আর্টিকেল ২, ১০, ১২, ১৩ ও ১৬)।

রাষ্ট্রপক্ষকে অবশ্যই
ক. অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের শিকার হয়েছে এমন ভুক্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা স্থাপন করা, যেখানে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হবে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্যাতন বা কোনো ধরনের অন্যায় আচরণের অভিযোগ তুললে কেউ ফের নির্যাতিত হবে না এবং অতি অবশ্যই সব অভিযোগের বিষয়ে ত্বরিত, নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত করা হবে।

খ. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং যেকোনো ধরনের আটক বা বন্দী ব্যক্তির সুরক্ষাসম্পর্কিত মূলনীতিগুলোর ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

বিতর্কিত আটক
২০১৮ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রায় ৫ হাজার সমর্থককে আটকের তথ্যের ব্যাপারে কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করছে, যেখানে দুর্নীতি মামলায় বিএনপি নেতা খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশের পর সহানুভূতি প্রদর্শন করা অনেক সাধারণ মানুষও ছিল। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধী দলের কয়েক হাজার সমর্থককে গ্রেপ্তার এবং তাদের অনেককেই এখনো আটক রাখার অভিযোগ সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করছে কমিটি। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে, এমন সন্দেহে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বাধীনতায় অযৌক্তিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়েও উদ্বিগ্ন কমিটি। (আর্টিকেল ২, ১১, ১২, ১৩ ও ১৬)

রাষ্ট্রপক্ষকে অবশ্যই রাজনৈতিক কর্মী, আন্দোলনকারী, গ্রেপ্তার ব্যক্তি, সহিংসতা রোধে গণজমায়েত থেকে আটকসহ সব আটক ব্যক্তিকে সত্যিকার অর্থেই আটককালীন সব মৌলিক নিরাপত্তা (১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত) দিতে হবে এবং দ্রুততম সময়ে তাকে বিচারকের সামনে হাজির করার বিষয়টিও রাষ্ট্রপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। ওপরে বর্ণিত প্রতিরোধমূলক কার্যকলাপের সময় আটক ব্যক্তিদের নির্যাতনের সব অভিযোগ দ্রুত ও কার্যকর তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তদন্তকারীদের সুপারিশক্রমে হয় বিচারের আওতায় আনা বা আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রপক্ষ উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানাচ্ছে কমিটি। কিন্তু একই সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলার খুবই অল্পসংখ্যকের বিচার ও সাজা হওয়া এবং একই সময়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আসা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান অভিযোগের বিষয়ে কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কমিটি আরও উদ্বিগ্ন এই তথ্য জেনে যে আইনি বাধার কারণে যৌন সহিংসতার শিকার নারীরা নিজেদের সঙ্গে হওয়া আচরণকে ধর্ষণ দাবি করতে পারছেন না। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, (বাল্যবিবাহ–সংক্রান্ত) আইনে আনা সাম্প্রতিক সংযোজনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ‘বিশেষ অবস্থা’র দোহাই দেখিয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের অনুমোদন দিচ্ছে, যা দেশে বিদ্যমান বাল্যবিবাহের উচ্চ হারকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। একই সঙ্গে কমিটি উদ্বিগ্ন এই কারণে যে রাষ্ট্রীয় আইন মায়ের প্রাণসংশয় ছাড়া গর্ভপাতকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করছে, যা নারীর শারীরিক ও মানসিক পীড়ন ও হতাশার কারণ হয়ে উঠতে পারে। (আর্টিকেল ২, ৪, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬)

রাষ্ট্রপক্ষের করণীয় সম্পর্কে কমিটির সুপারিশ
ক. নারী ও মেয়েশিশুদের বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সব ধরনের অভিযোগ, বিশেষ করে রাষ্ট্র কিংবা (জাতিসংঘ) সনদ মোতাবেক আন্তর্জাতিক পরিসরে রাষ্ট্রের দায় রয়েছে এমন অন্য কোনো সংস্থার কর্মকাণ্ড বা নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে জড়িত অভিযোগগুলোর পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অভিযুক্ত অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা যায় এবং দোষী সাব্যস্ত হলে তার যথাযথ শাস্তি বিধানের পাশাপাশি ভুক্তভোগী পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ ন্যায়ানুগ প্রতিকার পায়।

খ. নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত)-এ বিদ্যমান ধর্ষণের অভিযোগ দাখিল ও এ–সংক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিবেদন তৈরিতে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা–সম্পর্কিত বিধি অপসারণ করতে হবে।

গ. ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’ ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের আইনি নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিধান বাদ দেওয়া এবং ১৩ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে বৈবাহিক ধর্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান রহিত করা, যা দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় বর্ণিত আছে।

ঘ. ঘরোয়া সহিংসতা এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সেবা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা, দেশজুড়ে যেসব নিরাপদ জরুরি আবাসন ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা আছে, সেখানে এ ধরনের ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি যাঁরা দেশের নাগরিক নন, তাঁদেরও সেখানে আশ্রয় নেওয়ার অধিকার থাকতে হবে।

ঙ. গর্ভধারণ অব্যাহত রাখলে তীব্র যন্ত্রণা ও কষ্টের শিকার হতে হবে, এমন সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে গর্ভপাতের অনুমতিদানের জন্য আইনি ব্যতিক্রমের সুযোগ করে দিতে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানগুলো পর্যালোচনা করা। যেমন, ধর্ষণের কারণে বা নিকটাত্মীয়র সঙ্গে যৌন সঙ্গমের কারণে গর্ভধারণ ঘটলে বা মারাত্মক ভ্রূণবৈকল্যের ঘটনা থাকলে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নারীদের গর্ভপাত-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট নারী বৈধ বা অবৈধ উপায়ে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন কি না, তা এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হবে না। এ ধরনের সেবা নেওয়া বা দেওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট রোগী বা চিকিৎসককে আইনগত শাস্তি বা অন্য কোনো ধরনের হুমকির মুখোমুখি করা যাবে না।

পাচার
যৌন ও শ্রম পাচারের বিষয়টিকে অপরাধমূলক ঘটনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে ২০১২ সালে একটি আইনি বিধান প্রণয়ন করায় রাষ্ট্রপক্ষ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে কমিটি এই বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের একটা বিরাট বড় অংশই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা ঘটে থাকে প্রতিশোধের ভয় ও ভয়ভীতি দেখানোর কারণে। ঘটনার শিকার অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন না যে তাঁরা পুলিশের কাছ থেকে কার্যকর সুরক্ষা পাবেন। কমিটি আরেকটি বিষয়েও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সেটি হচ্ছে, ১০০টির বেশি ঘটনা পাওয়া গেছে, যেখানে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভেতরেই জোরপূর্বক শ্রম ও যৌন পাচারের শিকার হতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, সামরিক বাহিনী এবং পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচারের সুযোগ করে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের হাইকোর্ট রোহিঙ্গাদের দায়ের করা পাচারবিরোধী মামলাগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। আর কর্তৃপক্ষও এসব ঘটনার তদন্ত শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে (আর্টিকেল ২, ৪, ১০, ১১, ১৪ ও ১৬)।

রাষ্ট্রকে যা করতে হবে
ক. বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের যৌন ও শ্রম পাচারের বিষয়ে ওঠা অভিযোগগুলো নথিভুক্ত করতে হবে এবং যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে, তাঁদের তদন্ত ও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

খ. রোহিঙ্গাসহ পাচারের শিকার সব বিদেশি নাগরিককে সরকারি সেবার আওতায় আনতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সহিংসতার শিকার শিশু ও নারীদের জন্য বিদ্যমান সেন্টারগুলোতে প্রবেশাধিকার ও আইনি সহায়তা প্রদান। এ ছাড়া তাঁরা যে সহিংসতার শিকার, সে বিষয়ে দেশের বিচারালয়ের সামনে অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

গ. এমন বাস্তবসম্মত অবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে পাচারের শিকার ব্যক্তিরা অভিযোগ দায়ের করলে প্রতিশোধমূলক ঘটনার ভয় থেকে কার্যকর সুরক্ষা পেতে পারেন।

[অনুবাদ করেছেন আবু হুরাইরাহ্‌হারুন–অর–রশীদরাজিউল হাসান ও অর্ণব সান্যাল]