বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে আসে না

ক্লাসভর্তি বেঞ্চ। সকালের আবহাওয়াও ভালো। শিক্ষক ক্লাসে ঢুকলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! ক্লাসের অর্ধেক বেঞ্চ খাঁ খাঁ করছে। কখনো ১০০ জনের ক্লাসে ২৫ জন, কখনো দেড় শ জনের ক্লাসে ৪৫ জন, কখনোবা ৩০ জনের ক্লাসে ১৫ জন। এই চিত্রটাই এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন ছিল আজ থেকে ২৫ কিংবা ৩০ বছর আগে। শিক্ষকের লেকচার শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত শিক্ষার্থীরা। কখন আসবেন প্রিয় শিক্ষক? বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বর্তমান উপস্থিতির হার আমাদের উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত করেছে। ক্লাসে ছাত্রদের দেখতে না পাওয়া কতটা কষ্টের, সেটা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের ডায়াসে না দাঁড়ালে কেউ বুঝতে পারবে না।

প্রশ্ন আসতেই পারে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীর ক্লাস করাটা কেনই–বা গুরুত্বপূর্ণ? এর উত্তর বেশ কয়েকটা প্রেক্ষাপট থেকে আসবে। প্রথমত, বাংলাদেশে ঘরে বসে বা বাইরে থেকে অনলাইন লেকচার বা ই-লেকচার শোনার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি এবং ছাত্রকে ক্লাসেই আসতে হবে লেকচার শোনার জন্য। দ্বিতীয়ত, একজন ছাত্র যখন ক্লাস করে তখন শিক্ষকের পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাবনা তৈরির পরিস্থিতি তৈরি হয়। একই সঙ্গে কিছু না বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছে। এতে তার কল্পনাশক্তি, অনুধাবন করার ক্ষমতা এবং প্রাসঙ্গিক উদাহরণ জানা হচ্ছে। কিন্তু যখন সে ক্লাস না করে শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য নোট মুখস্থ করে, তখন কিন্তু এই দক্ষতাগুলো অর্জন তার জন্য একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর প্রচলিত নিয়মে একজন ছাত্রের ক্লাসে উপস্থিতির হার ৭০ শতাংশ না হলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি নেই। তারপরও তারা ক্লাসে আসছে না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অনুপস্থিতির অভিযোগ বেশি পাওয়া যায় কলা ও মানববিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে।

কেন ছাত্ররা ক্লাসে আসে না—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমরা শখানেক ছাত্রের ওপর একটা জরিপ করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম কেন তারা ক্লাস করে না। নিজের নাম উল্লেখ ছাড়া একটা কাগজে তারা লিখে দিয়েছে তাদের মতামত। আবার অনেকে সাহস করে সরাসরি বলে গেছে। যে কারণগুলো উঠে এসেছে তার কোনোটি অদ্ভুত, কোনোটি কৌতূহলোদীপক, কোনোটা উদ্বেগজনক আবার কোনোটা হতাশাজনক। সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা ছাত্ররা উল্লেখ করেছে তা হলো ক্লাসের লেকচার ভীষণভাবে অনাকর্ষণীয় মনে হয় তাদের কাছে। কোনো কোনো শিক্ষক ক্লাসে এসে একটা বই কিংবা নোট উল্টে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ে যান। একবারও বোঝানোর তাগিদ অনুভব করেন না, প্রাসঙ্গিক উদাহরণও দেন না। বিষয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়েও কিছু বলেন না। কয়েকজন মজা করে লিখেছে, ২০ বছর ধরে একই নোট পড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক, তাতে পুরোনো হলুদ পাতায় লেগে আছে তাঁর থুতুর দাগ। তাদের কথা হচ্ছে, ক্লাসে যদি কেবল লিখতেই হয়, তাহলে শিক্ষকের নোটটা ফটোকপি করে নিলেই হয়। আবার তরুণ শিক্ষকদের অনেকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা করেছে ডিজিটাল ফাঁকিবাজির অভিযোগ। পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডের নামে এক ক্লাসেই শেষ করে দিচ্ছেন গোটা একটা চ্যাপ্টার। যা নিয়ে আট কিংবা দশটি ক্লাস নেওয়ার কথা, সেখানে অনেক শিক্ষক পাওয়ার পয়েন্টের নামে এক বা দুই ঘণ্টায় ঝড়ের বেগে স্লাইডের লেখাগুলো শ্রুতিপঠনের মতো পড়ে যান। আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছে অনেক শিক্ষার্থী, তা হলো কিছু শিক্ষকের খুব রুক্ষ ব্যবহার তথা তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ। একজন ছাত্র এভাবে লিখেছে, ‘স্যারের সঙ্গে কথা হলে নিজেকে খুব তুচ্ছ মূল্যহীন মনে হয়। ক্লাস নেবেন কি না, সেটা জানতে চেয়ে মনে হলো উত্তর দিয়ে আমাকে ধন্য করছেন।’

কিছু কিছু ছাত্রের ক্লাসে না আসার কারণগুলো ভীষণ অদ্ভুত। তাদের সরল স্বীকারোক্তি, রাতে ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স আর পাবজি নিয়ে তাদের বড় সময় কাটে, ঘুমাতে ঘুমাতে রাত গভীর হয়ে যায়। ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। আর ক্লাসে এলেও মনোযোগ বসাতে পারে না। আমরা কি তবে একটা গ্যাজেট আর ফেসবুক মহামারিতে আক্রান্ত দিবাস্বপ্নচারী জাতিতে পরিণত হচ্ছি?

কিছু ছাত্রের উত্তর বেশ ভয়ংকর। তারা রাজনীতি করে। এবং তাদের বড় ভাইদের দেখে এসেছে কিংবা শুনে এসেছে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য বিশেষ অনুমতি জোগাড় করা যায় সহজেই। একজন লিখেছে, ক্লাস করা? ওসব তো নিরীহ আঁতেল ছেলেদের কাজ।

সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে কিছু শিক্ষার্থীর হতাশার কথা। যে ছেলেটা ইতিহাসে পড়ে সে বলছে, সে নিশ্চিত যে কোনো চাকরি মিলবে না। যে ছেলেটা মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়ে পড়ছে তার ধারণা, তার সামনে ধু ধু শূন্যতা। পছন্দের চাকরি সে পাবে না। কেউ কেউ বলেছে সে বিসিএস দেবে, তাই তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে ক্লাস করার চেয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়াই তার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবার ইচ্ছায় নির্দিষ্ট বিষয়ে ভর্তি হওয়ার কারণেও অনেকে ক্লাস করে না। কারণ, ওই বিষয় তার পছন্দ নয়, সে এতে মন বসাতে পারছে না।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে খুব গভীরভাবে। ভাবতে হবে কীভাবে তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনা যায়। সবার আগে দরকার ক্লাস লেকচার আকর্ষণীয় করা। এ জন্য প্রয়োজনে শিক্ষা গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ নিয়ে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে তার পছন্দের ও আগ্রহের বিষয়টিতে পড়া নিশ্চিত করা জরুরি। অভিভাবকদের উচিত নতুন করে ভাবা। তাঁদের বুঝতে হবে জীবনটা সন্তানের, তার নিজের নয়। ফেসবুক ও গ্যাজেট আসক্তি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। হতাশার জায়গা থেকে বের করে আনতে ছাত্রদের ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং করানোর উদ্যোগ নেওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে চাকরি অনেক রকম হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, জীবনটা অনেক সুন্দর, অনেক রঙিন, এত সহজে নষ্ট করে দেওয়ার নয়—এই বোধটা তৈরি করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও বিশ্বাস করি, ‘ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’ শিক্ষকদের ইতিবাচক প্রচেষ্টা তরুণদের আবার ফিরিয়ে আনতে পারে ক্লাসরুমে। আমরা আমাদের এই সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে ভার্চু্যয়াল জগতে নয়, বাস্তবের ক্লাসরুমে সক্রিয় চাই।

লেখকেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইতিহাস ও প্রাণরসায়ন বিভাগের শিক্ষক