শিক্ষক হিসেবে কাদের কাছে যাবেন

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এতে অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এর পাশাপাশি আন্দোলন রুখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জারিকৃত এক আদেশে গতকাল শনিবার সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি আবাসিক হল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে ‘জরুরিভিত্তিতে’ এই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ সবই হয়েছে একই দিনে।

এই হামলা থেকে নিজেদের বাঁচাতে শিক্ষার্থীরা ধানের খেতসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছেন। সেখানে এবারই প্রথম শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বড় ধরনের আন্দোলন তৈরি করেছেন। এর আগে যতবারই সেখানে যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, সবই শোকজ জারি করে, শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি দিয়ে দমানোর চেষ্টা হয়েছে। সেখানে প্রশাসনের মনমতো কিছু না হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্টের অভিযোগ এনে শিক্ষার্থীদের সাময়িক বা স্থায়ী বহিষ্কারের নোটিশ পেতে হয়। শুধু গত এক বছরেই অন্তত ২৭ শিক্ষার্থীকে এ ধরনের বহিষ্কারের নোটিশের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে এসব নোটিশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচণ্ড ভয়ভীতি সৃষ্টি করেছে। তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা-চেতনায় বড় ধরনের আঘাত করছে। অবস্থা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তাঁরা কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করতে চান। অথচ এই জীবনটিই হওয়ার কথা সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত।

বেশ কয়েক বছর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন দমানো এবং প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে শোকজ, সেটিতে কাজ না হলে তাঁদের বিরুদ্ধে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ, মামলা এবং হামলা চালানো হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের জ্ঞাতসারে এবং পরিকল্পনাতেই হয়।

বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা হামলার পর বিবৃতি দেন, তাঁরা এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। যদি তাঁদের কথা সত্যিই ধরে নিই, তাহলে ফিরতি প্রশ্ন করতে চাই, যখন আপনার শুনতে পান আপনাদের শিক্ষার্থীদের কে বা কারা মারছে, তাঁদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তি হিসেবে আপনি তখন কী করেছেন? সেই সময়ই কি আপনি তাঁদের হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? কয়জনকে রক্ষা করার জন্য আপনি শিক্ষক হিসেবে বুক পেতে দিয়েছেন? আর এই না করার মধ্য দিয়েই আপনি/আপনারা প্রমাণ দেন যে শিক্ষার্থীদের ওপর এই হামলা, মামলায় আপনাদের সায় আছে, কিংবা আপনাদের নির্দেশেই এগুলো হয়।

যে ভিসিরা শুধু তাঁদের ক্ষমতার আসনটি ঠিক রাখতে গিয়ে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের আহত করাতে পারেন, আর যা-ই হোক তাঁদের কাছে কোনোভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিরাপদ নয়। শিক্ষকদের খুব ভালো করে মনে রাখা প্রয়োজন যে উপাচার্য পদটি সাময়িক। কিন্তু শিক্ষক পরিচয়টি স্থায়ী। একটি পদে থাকার লোভে শিক্ষার্থীর ওপর হামলা যে শিক্ষক করাতে পারেন কিংবা আমলে আনতে পারেন, কীভাবে তাঁরা শিক্ষার্থীদের সামনে গিয়ে আর দাঁড়াবেন। যে উপাচার্য দাবি করেন যে তিনি শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, তিনি কীভাবে আন্দোলন দমানোর জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান?

উপাচার্যদের বিনয়ের সঙ্গে জানাতে চাই, হামলা, মামলা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ ঘোষণা করে আন্দোলন দমানো যায় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ইতিহাস অনন্ত তা-ই বলে।

ইতিহাস থেকে উপাচার্যরা কোনো কিছুই কি শেখেন না। না শেখেন না, কারণ তাঁরা মনে করেন এ দেশে জনগণের মতো শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষমতা নেই। সব ক্ষমতা দলীয় প্রধানদের হাতে। তাই তাঁরা দলকে খুশি রাখতেই ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু ইতিহাসই আমাদের জানিয়েছে, এই অসীম ক্ষমতা চূর্ণ হয় খুব অল্প সময়ে। দেখুন উপাচার্য যাঁদের শোকজ করে, ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি দিয়ে একদিন চুপ করিয়েছিলেন, কিন্তু আজ তাঁদের হাতেই প্রতিবাদী মশাল। ভেবেছিলেন, ওঁরা ভয় পেয়েছেন, চুপসে গেছেন। কিন্তু না তাঁরা তাঁদের দ্রোহ দ্বিগুণ করেছেন। তাঁদের আরও মার খাওয়ানোর পরিকল্পনা যদি থাকে, তবে এখনই তা বাতিল করুন। শিক্ষক হিসেবে শেষমেশ কাদের কাছে যাবেন?

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]