কর্তৃপক্ষই মাস্তানদের সহায়তা দেয়

>ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ৩৪ জনের ভর্তি, ক্যাম্পাসে মারধর ও উপাচার্য নিয়োগে বিলম্বের মতো বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: গত বছর শহীদ মিনারে লাঞ্ছনার প্রতিকার পেয়েছিলেন? 

তানজীমউদ্দিন খান: ১৯৯২ সালে ছাত্র থাকতে ছাত্রদলের হাতে মার খেলাম আর শিক্ষক হিসেবে গত বছর শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত ও গালিগালাজের শিকার হলাম। এমনকি মাসখানেক আগে সরকার সমর্থক একজন অধ্যাপক হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। কিন্তু কখনো এসবের প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব আমলেই দলীয় মাস্তান আর সন্ত্রাসীদের সহায়তা নেয়, অথবা সহায়তা করে। তাই খুব কম ক্ষেত্রে এসব অন্যায়–অনাচারের প্রতিকার হয়। 

প্রথম আলো: ভর্তি পরীক্ষাবিহীন ৩৪ শিক্ষার্থীর বিষয়ে আন্দোলনরতদের ওপর হামলার পর প্রক্টর ‘সীমা লঙ্ঘনের প্রবণতা’কে দায়ী করেছেন। কে সীমা লঙ্ঘন করল? তদন্ত আশা করেন? 

তানজীমউদ্দিন খান: তদন্ত হয় না। কখনো তদন্ত হলেও মোটা দাগে দলনিরপেক্ষ কারও দ্বারা কোনো তদন্ত হয় না। যদি–বা কখনো হয়, আর সরকারি ছাত্রসংগঠনের কারও অভিযুক্ত হওয়ার বিষয় থাকে, তখন আবার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশে গড়িমসি বা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ না করার একটা প্রবণতা থাকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ যদি সীমা লঙ্ঘন হয়, তবে ‘সীমা লঙ্ঘনকে’ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার দাবি রাখে। 

প্রথম আলো: আগের মতো ছাত্রদল-ছাত্রলীগের বন্দুকযুদ্ধ থেমে গেছে। 

তানজীমউদ্দিন খান: বন্দুকযুদ্ধ অশান্তি। কবরের নীরবতাও একধরনের অশান্তি। একটি নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করেছে, ক্যাম্পাসে অন্য কোনো সংগঠনের জোরালো অস্তিত্ব নেই। তবে একচ্ছত্র ক্ষমতা তাদের নিজেদের মধ্যকার জেলা ও নেতাভিত্তিক উপদলীয় কোন্দলের তীব্রতা দিয়েছে। পকেট থেকে গুলি বেরিয়ে নিজেই আহত হওয়ার মতো খবরও পড়ি। তাই আপনি ক্যাম্পাসের আগের অনেক কিছু দেখছেন না বলে পরিস্থিতির তেমন বদল ঘটেছে, বিষয়টি তা নয়। আবার মিডিয়ার সংখ্যাধিক্যের কারণে লুকোছাপাতে সতর্কতা বেড়েছে। সহিংসতা রয়ে গেছে। বরং যখন অস্ত্র নিয়ে সংঘাত হতো, তখন বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকার কারণে শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সাধারণ ছাত্ররা কম ক্ষেত্রেই আক্রান্ত হতো। এখন আর পার্থক্য নেই, রাজনীতি করুক, না-ই করুক, যে কেউ যখন-তখন আক্রান্ত হতে পারেন। তাই পরিস্থিতি আগের থেকে অবনতিশীল হয়েছে। 

প্রথম আলো: জাহাঙ্গীরনগরে টাকার ভাগ নিয়ে যা ঘটল, তা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত? 

তানজীমউদ্দিন খান: চাঁদাবাজির টাকার অঙ্ক নিয়ে দর-কষাকষি মনঃপূত না হওয়ার কারণে উপাচার্য ও ছাত্রলীগের মধ্যে যা কাদা-ছোড়াছুড়ি হয়েছে, সেই কারণে বিষয়টি জনসমক্ষে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম চাঁদাবাজি নীরবে চলছে। ঠিকাদার আর হল প্রভোস্টরাই বাস্তবতা সব থেকে ভালো জানেন। সরকারি সংগঠন সব সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা ঠিকাদারদের কাছে চাঁদা, ঈদ বোনাস, ঈদের সালামি দাবি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের হলগুলোতে যান, দেখবেন সারি সারি দামি মোটরসাইকেল, এমনকি দামি প্রাইভেট কার। সাইকেল রাখার জায়গা হয় না। কোনো কোনো হলে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। আবাসিক হলের ছাত্র কী করে এসবের মালিক হয়? এটা তো সর্বজনবিদিত যে বিজয় একাত্তর হল নির্মাণের সময় নাকি ঠিকাদার সরকারি সংগঠনকে ২০০ মোটরসাইকেল দিয়েছেন। এসব তো এখন স্বাভাবিক ঘটনা। 

প্রথম আলো: স্বাধীনতার চার দশকে দুই হাজার এবং গত এক দশকে নয় শ শিক্ষক নিয়োগের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবনতিশীল পরিস্থিতির যোগসূত্র? 

তানজীমউদ্দিন খান: অবশ্যই। অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগের মান অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটের রাজনীতিতে ভারসাম্য টেকসই করা এর লক্ষ্য। তবে উপদলীয় বিভক্তির কারণে এখন উপাচার্যরা নিজ দলের ওপর আস্থা রাখেন না। 

প্রথম আলো: ভর্তি পরীক্ষা দিলেই ৩৪ ছাত্রের ভর্তি শুদ্ধ হতো? তাহলে মঞ্জুরি কমিশনের নতুন সুপারিশমতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে এখন লিখিত পরীক্ষা চালু হলেই আমরা বাঁচব? 

তানজীমউদ্দিন খান: বাঁচার উপায় তো নেই। তবে শুধু ৩৪ কেন, এর বাইরে যারা ভর্তি হয়েছে, সবটারই পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাই। বিশ্ববিদ্যালয় একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। এভাবে ভর্তি করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি ঘটেছে, অনিয়ম হয়েছে। অন্যান্য সব সূচকই নিম্নমুখী থাকতে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ চালু করলেই মুক্তি মিলবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদানের গুণমান কি তাহলে শিক্ষক তৈরির উপযোগী নয়, সেই ঘাটতি দূর হবে একটি লিখিত পরীক্ষা দিয়ে? অনৈতিক চর্চা চলতে থাকলে লিখিত পরীক্ষা ঘাটতি দূর করবে না। তদুপরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভর্তি পরীক্ষা এখনো অনন্য। এটা ম্যানিপুলেট করা সহজ নয়। যদিও বিএনপির গত আমলে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভর্তি কেলেঙ্কারি ঘটে। ২০০৭ সালে তদন্তকারী হিসেবে আমাদের বিভাগেই এক শর বেশি ছাত্রকে বহিষ্কার করি। তদুপরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে এখনো গর্ব করি। সন্ধ্যাকালীন কোর্সগুলোতে ছাত্র ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করলে তা সুফল দেবেই। 

প্রথম আলো: উপাচার্য নিয়োগ থমকে আছে, এখন তো প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগের কথা শোনা যায়। এমনকি প্রশাসক নিয়োগের আশঙ্কা করেন? 

তানজীমউদ্দিন খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটা ঘটেনি। তবে উপদলীয় কোন্দল এড়াতে প্যানেলের এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে নিতে পারে। এটা উড়িয়ে দেব না। 

প্রথম আলো: বিশ্বসেরা এক হাজারের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের না থাকাটাকে কীভাবে দেখেন? 

তানজীমউদ্দিন খান: যদিও ১০০ বছর বয়স হয়েছে, তবে উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ হওয়ার লক্ষণগুলো মোটা দাগে অনুপস্থিত। র‍্যাঙ্কিংয়ে থাকার জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা দরকার। এ জন্য পাঁচটি মান নির্ধারক আছে, শিক্ষণ, গবেষণা, উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিকতা ও নিজস্ব আয়। শেষ দুটি বাংলাদেশের বাস্তবতায় অপ্রাসঙ্গিক। এখন প্রশ্ন হলো উপাচার্য নিয়োগের আগে কেউ কি জানতে চাইছে যে চার বছর দায়িত্বে থাকতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোথায় নিতে চান। তার মানে র‍্যাঙ্কিংয়ে নেওয়াটা তো সরকারের ভাবনাতেই নেই। মেধা, যোগ্যতার সঙ্গে এমন ভাবনায় যিনি ঋদ্ধ, তাঁকেই তো উপাচার্য হিসেবে নিতে হবে। আর এটা সম্ভব হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে সহজে। 

প্রথম আলো: ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকের পদে ইতিহাসের প্রথম অপসারণের কী প্রভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দেখেন? 

তানজীমউদ্দিন খান: এ তো শুধু মুখের পরিবর্তন, অপরাজনীতির কাঠামোর পরিবর্তন নয়। নবাগতদের মুখে ‘পিঠের চামড়া তুলে নেওয়ার’ উক্তি শুনলাম। ছাত্রনেতার মুখে এই ভাষা আসে তখন, যখন তাঁর শক্তি বা অপশক্তির উৎস অভিন্ন থাকে।

প্রথম আলো: এই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিষয়টি আপনাকে বেশি বিচলিত করছে, যার প্রতিকার আপনি অবিলম্বে আশা করেন? 

তানজীমউদ্দিন খান: দলীয় রাজনীতি, আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতি দলনির্ভর হলেও আসলে এটা খুবই ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক। সংশ্লিষ্ট দলের নীতি, আদর্শ যাঁরা দাবি করেন, তাঁরা সবাই তা ধারণ করেন না। তাঁরা শুধু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দলীয় রাজনীতির খাতায় নিজেদের নাম লেখান। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বড় সংকট। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ। 

তানজীমউদ্দিন খান: ধন্যবাদ। 

আরও পড়ুন: