সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে

গত দুই বছরে মিয়ানমারে পরিস্থিতি একটুও বদলায়নি এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি
গত দুই বছরে মিয়ানমারে পরিস্থিতি একটুও বদলায়নি এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশন উপলক্ষে বিশ্বনেতারা এখন নিউইয়র্কে। বাংলাদেশ ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ওআইসির যৌথ উদ্যোগে আজ মঙ্গলবার সেখানে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। সভাটি আয়োজিত হয়েছে এমন সময়ে, যা তিনটি কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, দুই বছরের মধ্যে জাতিসংঘের তদারকিতে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের নিয়োগ করা স্বাধীন তথ্য অনুসন্ধান দল গত সপ্তাহে মানবাধিকার পরিষদে পেশ করা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত দুই বছরে মিয়ানমারে পরিস্থিতি একটুও বদলায়নি এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ নেই। তৃতীয়ত, অনুসন্ধানী দল যেমন মিয়ানমারের চিহ্নিত জেনারেলদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার দাবি করেছে, তেমনই দাবি করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং তা গত সপ্তাহেই। 

সন্দেহ নেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী দলের ‍মূল্যায়নটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তারা ঠিক কী বলেছে, তা একটু দেখে নেওয়া যাক। অনুসন্ধানী দলের প্রধান মারজুক দারুসমান মানবাধিকার পরিষদে বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী স্পষ্টতই রোহিঙ্গা, কাচিন, শানসহ সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষী নীতি অনুসরণ করছে এবং তার পরিবর্তন না ঘটলে সেখানকার পরিস্থিতি বদলাবে না। তাঁদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে এখনো যে কয়েক লাখ জাতিগত রোহিঙ্গা রয়েছে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় তারা এখন গণহত্যার শিকার হওয়ার আরও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলা এবং দেশ থেকে বিতাড়নের সরকারি চেষ্টা পুরোদমে অব্যাহত আছে এবং সেটাই গণহত্যার পুনরাবৃত্তির ‍ঝুঁকির কারণ। তাঁদের ভাষ্য, ২০১৭ সালে যেসব কারণে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়; সামরিক বাহিনী কর্তৃক সেই হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নির্যাতন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক কিছুই অব্যাহত আছে। 

রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাদোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও স্বার্থের বিশদ বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, এই স্বার্থ ভেঙে দিতে না পারলে ওই বাহিনীর ওপর বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না এবং তারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বেই থেকে যাবে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের খোলসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আর সেসব জমিতে তাদের ফিরতে না দেওয়ার সঙ্গে এসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রয়েছে। 

অনুসন্ধানী দলের এসব পর্যবেক্ষণের প্রতিধ্বনি করে মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার, মিস ইয়াং হি লি ইউএন নিউজকে বলেন যে মিয়ানমারের গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। মিস লির অভিমত, মিয়ানমারকে অবশ্যই আইসিসির মুখোমুখি করা দরকার। এসবের জন্য দায়ী সেনাপ্রধানসহ সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা, বিশেষভাবে ৩৩ নম্বর ব্যাটালিয়ন ও ৯৯ নম্বর ব্যাটালিয়ন এবং সেগুলোর অধিনায়কদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, এরাই রাখাইনে বর্বরতার জন্য দায়ী। কাচিন এবং উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যেও এই দুটি ব্যাটালিয়নই নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিচ্ছে। 

জাতিসংঘ অনুসন্ধানী দলের বক্তব্যে দেশটির অপরাধের বিবরণগুলো উঠে আসা ন্যায়বিচারের দাবিকে জোরদার করবে সন্দেহ নেই এবং এটা একটি বড় প্রাপ্তি। কিন্তু পাশাপাশি হতাশার কারণও ঘটেছে। মানবাধিকার পরিষদে আবারও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভাজনের প্রতিফলন ঘটেছে। মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা অনুসন্ধানী দলের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং মিয়ানমারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাফাই গেয়েছেন। তাঁরা বিষয়টিকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা এবং দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমেই তা নিষ্পত্তির কথা বলেছেন। নাগরিকত্বের মৌলিক অধিকার হরণ, গণহত্যা, নিপীড়ন কিংবা অমানবিক বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় নীতিগুলোর বিষয় এই দুই দেশের কাছে উপেক্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চীনকেই বরং উপযুক্ত মধ্যস্থতাকারী মানছেন। বলা হয়েছে, নিউইয়র্কে চীনের মধ্যস্থতায় একটি ত্রিপক্ষীয় আলোচনা হবে। 

অথচ মানবাধিকার পরিষদে মিয়ানমারের প্রতিনিধির আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে চীন ও মিয়ানমারের অর্থনৈতিক স্বার্থ কতটা সম্পর্কযুক্ত। মিয়ানমারের প্রতিনিধি সামরিক বাহিনীর অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি অস্বীকার করেননি। বরং যুক্তি দিয়েছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বাধাগ্রস্ত হলে হাজার হাজার মানুষ কাজ হারাবে, বেকার হবে। তিনি মিয়ানমারকে সংস্কারের জন্য সময় দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এবং সামরিক বাহিনীর বাণিজ্যে চীনের ভূমিকার কথা সবারই জানা। সুতরাং, যেখানে এই দুই দেশের স্বার্থের সম্মিলন ঘটেছে, সেখানে চীনের পক্ষপাতিত্ব কার প্রতি থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। 

ওআইসির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশ জাতিসংঘে আলোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা বরং অনেক বেশি যৌক্তিক বলেই মনে হয়। সংকট সমাধানে সরকার এই ফোরামে কী প্রস্তাব তুলে ধরে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন প্রকাশ এবং আইসিসিতে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা করার দাবি ও সম্ভাবনা বৃদ্ধির পটভূমিতে বিষয়টিকে আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকারের তালিকায় নিয়ে আসার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। 

বিপরীতে, অবশ্য আশ্রিত উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও উসকানি তৈরির সাম্প্রতিক সমন্বিত ও সংঘবদ্ধ চেষ্টা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুর দমন–পীড়ন ও গণহত্যা চালায়, তার দুই বছর পূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা গত ২৫ আগস্ট আশ্রয়শিবির এলাকায় এক স্মরণসভার আয়োজন করে। এরপর থেকেই সরকারের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে ছোটখাটো কিছু অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশ্রিত উদ্বাস্তুদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার উদ্দেশ্য থেকে যদি কেউ বা কোনো গোষ্ঠী এ ধরনের চেষ্টা চালায়, তবে তা দুঃখজনক পরিণতি ডেকে আনবে। সরকারও তার দায় এড়াতে পারবে না। 

সম্প্রতি কথিত বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর মৃত্যু ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের নজর কেড়েছে এবং তাঁরা এগুলোর তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন। রোহিঙ্গা শিশুদের স্কুলের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া হাতে গোনা কয়েকজন, বিশেষত ছাত্রীদের বহিষ্কার নিয়েও আন্তর্জাতিক পরিসরে চাপা অস্বস্তি জোরদার হচ্ছে। অনেকেই প্রকাশ্যে এসব নীতির সমালোচনা করেছেন। সর্বসম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় আলাদা নিরাপত্তাবেষ্টনী নির্মাণের প্রস্তাব উঠেছে, যা নতুন সমালোচনার জন্ম দেবে। আশ্রয়শিবিরগুলোকে বৃহৎ আকারের কারাগারে রূপান্তরের কথা উঠবে। 

তাই এই আন্তর্জাতিক ও মানবিক সংকটের মানবিক সমাধান খুঁজতে হবে এবং অবশ্যই তা হতে হবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যে ৫ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার মধ্যে দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ অনুসন্ধানী দল গঠন এবং তাদের প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাকি চারটি প্রস্তাবের কোনোটির ক্ষেত্রেই কোনো অগ্রগতি নেই। ওই চার প্রস্তাবেরও তিনটি মিয়ানমারের জন্য প্রযোজ্য: সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধ করা, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন। মিয়ানমারের ভেতরে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি কার্যত হিমঘরে চলে গেছে। অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন সাক্ষ্য দেয়, মিয়ানমার তার করণীয়গুলোর একটিও প্রতিপালন করেনি। 

এই পটভূমিতে মিয়ানমারের ভেতরে সুরক্ষাবলয় প্রতিষ্ঠার দাবি আবার সামনে আনা প্রয়োজন। আইসিসিতে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের যে সুপারিশ জাতিসংঘে এসেছে, তার বাস্তবায়নও অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। আর সে কারণেই মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোর যে তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ এসব সেনাকর্তার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার প্রতি সমর্থনও কম গুরুত্ব বহন করে না। 

কামাল আহমেদ সাংবাদিক