সংকটে সংবাদপত্রশিল্প

সমতা ও ভারসাম্যের নীতি একটি সর্বজনীন নীতি। কিন্তু সংবাদপত্রশিল্পের সংগঠন নোয়াব মনে করে, সম্প্রতি ঘোষিত নবম ওয়েজ বোর্ডের প্রজ্ঞাপনে তার প্রতিফলন ঘটেনি। অন্যদিকে সাংবাদিক সংগঠনগুলো নোয়াবের বিবৃতিকে অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করেছে। সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের জারি করা রুলের উত্তর রাষ্ট্র এখনো দেয়নি। আবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আগামী ২০ অক্টোবর এ–সংক্রান্ত একটি শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে। অথচ সরকার সাব–জুডিশ রুল অগ্রাহ্য করল। সরকারের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, ওয়েজ বোর্ড কার্যক্রম পরিচালনা করবে শ্রম মন্ত্রণালয়। কেন সেটা তথ্য মন্ত্রণালয় করল, তার সদুত্তর নেই। 

সামগ্রিক দিক বিবেচনায় আমরা মনে করি, মজুরি নিয়ে একটি অধিকতর যুক্তিসংগত এবং সমঝোতামূলক সমাধানে পৌঁছানোর সুযোগ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। এ জন্য আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উপায়ে ওয়েজ বোর্ডকে একটি অর্থপূর্ণ ও যৌক্তিকীকরণের পথ খোলা রয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যদি কার্যকরভাবে শুনানি প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, তাহলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে তা সহায়ক হতে পারে। 

মজুরি নির্ধারণের সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। সংবাদপত্রশিল্পের সুরক্ষায় মালিক ও শ্রমিক উভয়ের সমান স্বার্থ রয়েছে। তাই দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করে এই বিষয়ে একটি ‘উইন উইন’ অবস্থায় পৌঁছানো যায়, সে বিষয়ে সবার একটা আন্তরিক উদ্যোগ প্রত্যাশিত। চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নির্মোহভাবে বিবেচনা করা উচিত। 

নোয়াব ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোর বক্তব্যে শিল্পের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার আহ্বান রয়েছে। সাংবাদিক সংগঠন বলছে, মালিকপক্ষের প্রতিষ্ঠানকে সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান মনে করে সব সময় কাজ করে থাকেন। নোয়াব বলেছে, ‘তারা কখনো ওয়েজ বোর্ডের বিরুদ্ধে নয়। সে জন্য অনেক আপত্তি সত্ত্বেও আমরা ওয়েজ বোর্ডের কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করেছি। ওয়েজ বোর্ডকে মালিক-সাংবাদিক উভয় পক্ষের জন্য বাস্তবসম্মত করার অনুরোধ করেছি।’ নোয়াবের কথা হলো, সরকারি পে–স্কেল ও বহুজাতিক কোম্পানিসহ দেশের অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে সংবাদপত্রশিল্পের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। তারা প্রশ্ন তুলেছে, দেশের ৪২টি শিল্পের মধ্যে ৩৮টি শিল্পের বেতন–ভাতা অষ্টম ওয়েজ বোর্ডের ধারেকাছেও ছিল না। সাংবাদিকদের বক্তব্য হলো সাংবাদিকদের কাজের ধরন ও ঝুঁকিগুলো ভিন্নমাত্রার, তাই অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে তুলনা খাটে না। দুই পক্ষের এই রকম যুক্তি সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে এটা অপ্রিয় সত্য যে ঘোষিত ওয়েজ বোর্ডগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমে থেকে গেছে, যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। এর কার্যকর তদারকি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র তৎপর হয়নি। 

 গত দুটি ওয়েজ বোর্ডের মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা বাস্তবে কে কতটা দিয়েছে তার যদি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, তাহলে একটি মলিন চিত্রই বের হয়ে আসবে। নোয়াব বলেছে, ‘কষ্ট হলেও কিছু সংবাদপত্র’ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে সচেষ্ট। তবে সীমাবদ্ধতা ও অসংগতি সত্ত্বেও এতকাল যে অবস্থা চলছিল, তা থেকে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। ছাপা পত্রিকার ওপর অনলাইনের যে অভিঘাত, তা যুগান্তকারী। 

যদিও আয়কর ও গ্র্যাচুইটির বিশেষ বিধানকে প্রচলিত শ্রম ও আয়কর আইনের সঙ্গে এবার সংগতিপূর্ণ করা হয়েছে। কিন্তু এটা মানতে হবে যে সংবাদপত্রশিল্প এখন এক কঠিন সময় পার করছে। সব পত্রিকার বিজ্ঞাপন আয় ও প্রচারসংখ্যা ক্রমাগত নিম্নমুখী। উপরন্তু সরকার যুক্তিসংগতভাবে বিজ্ঞাপন হার বাড়ায়নি, এমনকি বড় অঙ্কের বিল বকেয়া রাখাই তার প্রবণতা। অন্যদিকে এই শিল্পের ঘাড়ে ভ্যাট ও করের বোঝা চাপানো হয়েছে। মুদ্রণ সাংবাদিকদের বিশেষ সুরক্ষা দিতে হলে রাষ্ট্রকে তার ন্যায্য হিস্যা বহন করতে হবে। বিজ্ঞাপনের রেট বৃদ্ধি, বকেয়া শোধ ও ভ্যাট-কর হ্রাসে সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে আশ্বাস মিললেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এমন একটি পরিস্থিতিতেই একতরফা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ বেতন বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংবাদপত্র যখন নিয়মিত বেতন দিতে পারে না, ভর্তুকি দিয়ে চলে; সমাজে ও বাক্‌স্বাধীনতার উল্লিখিত বিষয়গুলোর অভিঘাতের দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।