শরণার্থী ও স্থানীয়দের সম্পর্কের অবনতি

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পর্ক এখন অত্যন্ত বিরূপ হয়ে উঠেছে
মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পর্ক এখন অত্যন্ত বিরূপ হয়ে উঠেছে

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পর্ক এখন অত্যন্ত বিরূপ হয়ে উঠেছে। নানা তৎপরতা সত্ত্বেও যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোনো আশাব্যঞ্জক খবর নেই, তখন তাদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতির ফলে চলমান শরণার্থী সংকটে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রশাসনসহ সব মহলই এতে উদ্বিগ্ন। ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে এসে মনে হয়েছে, পাশাপাশি অবস্থানরত দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান সন্দেহ-বিদ্বেষ ও চাপা উত্তেজনা সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে দলে দলে ছুটে আসা নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও স্বজনহারা রোহিঙ্গাদের প্রতি যে করুণা ও মমতার উদ্রেক হয়েছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের মনে, যেভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অন্ন-বস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে উখিয়া-টেকনাফ অভিমুখী যাত্রায় শামিল হয়েছিল মানুষ, সেই সহমর্মিতার খুব সামান্যই হয়তো আজ অবশিষ্ট আছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আবেগের মাত্রা কমেছে বটে, কিন্তু যেসব অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে এই শরণার্থীরা, সেখানকার অধিবাসীরা শুধু বিরক্তই নয়, নানা কারণে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে এদের ওপর। উখিয়া-টেকনাফ ও কক্সবাজারের নানা শ্রেণি-পেশার অন্তত এক শ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন একজন মানুষের দেখা পাইনি, এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি যাঁর সহমর্মিতা বা ইতিবাচক ধারণা আছে। এটা বেদনাদায়ক মনে হতে পারে পাঠকের কাছে।

উখিয়া কোর্টবাজার এলাকার একটি বিপণিবিতানে কথা হয়েছিল কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী আদিল চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি সম্পর্কের অবনতি সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলেন, সেই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শুনেছি থাইংখালী এলাকায় একটি ওষুধের দোকানে বৈকালিক আড্ডায় বসা কয়েকজন মুরব্বি গোছের ব্যক্তির কাছে। তাঁদের মধ্যে মোজাফফর আহমদ নামের একজন ইউপি সদস্যও ছিলেন। বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরে দেখা হয়েছিল একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরুণ কর্মী মো. মহসিনের সঙ্গে। শরণার্থীদের ত্রাণ ও সেবাদান প্রকল্পে কাজ করার জন্য এ এলাকায় নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু এনজিওর ভাষায় এই ‘উপকারভোগী’দের ওপর চরম বিরক্তি প্রকাশ করলেন মহসিন। সেই একই প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল নলবনিয়া সরকারি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কথায়ও। টেকনাফ বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল গণির বক্তব্যের সঙ্গে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় সিএনজি অটোরিকশার চালক আমির হোসেনের মতও যেন অভিন্ন।

বুঝতে চেষ্টা করেছি, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান এই বিরূপ মনোভাব কেন? মোটাদাগের কিছু বাস্তবতা তো আছেই। যেমন দলে দলে কিছু মানুষ আমার ঘরবাড়ির আঙিনায়, আমার পাহাড়-বাগান-খেত-খামারে ঢুকে পড়লে তাতে আমার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ নষ্ট হবেই। হাজার-লাখ মানুষের পদচারণ, কোলাহলে আমার শান্ত নিরুপদ্রব জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসবে অশান্তি। উখিয়া-টেকনাফ-কক্সবাজারের মানুষ এভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্বারা। আগে স্থানীয় লোকজন খাসজমি ও পাহাড়ি এলাকায় সরকারি বরাদ্দ পেয়ে সামাজিক বনায়ন, পানের বরজ, অন্যান্য শাকসবজি, ফসল ইত্যাদি উৎপাদন করেছেন, গরু-ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন। এখন এসব জমি ও পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির। ফলে স্থানীয় ব্যক্তিদের জীবিকা ও আয়-উপার্জনের ওপর প্রভাব পড়েছে। শ্রমবাজারেও জায়গা হারিয়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। কারণ, রাস্তাঘাটের নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে কুলিকামিনের কাজ পর্যন্ত দৈহিক শ্রমনির্ভর নানা পেশায় তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে ঢুকে পড়েছে রোহিঙ্গারা।

আবার স্থানীয় অধিবাসীদের এসব ক্ষতি ও দুর্গতির কথা মনে রেখেও বলতে হবে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমনকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় যেভাবে দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে, তার অনেকটা সুফল শরণার্থীরা পেলেও স্থানীয়রাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপকৃত হয়েছে। যেমন বিভিন্ন এনজিওতে চাকরি পেয়েছেন এলাকার শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত তরুণেরা। স্থানীয় দরিদ্র লোকজনকেও শরণার্থীদের মতোই কিছু কিছু সাহায্য–সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সংস্থার পক্ষ থেকে। স্থানীয় বিত্তবান, উচ্চ মধ্যবিত্তদের জমিতে দ্রুত পাকা, সেমিপাকা ও বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে ও হচ্ছে এবং সেগুলো ভালো অঙ্কের টাকায় শাখা কার্যালয় হিসেবে ভাড়া নিয়েছে দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো। বিভিন্ন এলাকা থেকে এনজিওকর্মীরা এখানে কাজ করতে এসেছেন বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা ঘরবাড়ি ভাড়া দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি সচল প্রবাহ রয়েছে এ এলাকায়।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এই লাভ–ক্ষতি আমাদের চেয়ে স্থানীয় অধিবাসীরা কম বোঝেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠার কারণটা কী? স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, তাৎক্ষণিক কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতির যে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ইয়াবার বিস্তার, চুরি-ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধ বেড়ে যাওয়া, জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই বলে দ্রুত বাড়তে থাকা জনসংখ্যা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, এমনকি রোগের বিস্তার ইত্যাদি নানা কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিকে আঙুল তুলছেন তাঁরা।

উখিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে কুতুপালং বালুখালী ক্যাম্পের দিকে যাওয়ার পথে গাড়িতে একজন সহযাত্রী জানতে চাইলেন, ‘রাস্তাঘাটের অবস্থা কেমন দেখছেন?’—স্বীকার করতেই হলো খুবই খারাপ। ভদ্রলোক ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, ‘লাখ লাখ মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রীবোঝাই ট্রাক আসছে, এনজিওগুলোর বড় বড় গাড়ি আসছে, অ্যাম্বুলেন্স আসছে...রাস্তার আর দোষ কী বলেন? এই রাস্তা দিয়েই আমাদের প্রতিদিন চলাফেরা করতে হচ্ছে।’

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে স্থানীয় গ্রামবাসীর সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তারা বড়ই ‘অকৃতজ্ঞ’। এ দেশে আশ্রয় পেয়ে তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতার বোধ তো নেইই, উল্টো তাদের কারণে বৈদেশিক সাহায্য আসছে বলেই স্থানীয় লোকজন বেশ খেয়েপরে বেঁচে আছে, এমন একটি ধারণা তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা বলতে চান। এদের আচরণ খুবই উদ্ধত বলেও অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের। অভিযোগের সত্যতা কিছুটা চাক্ষুষ করা গেল। কুতুপালং রোহিঙ্গা বাজার এলাকায় একদল উঠতি বয়সের তরুণের দেখা পেলাম, যারা খুবই উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া গোছের। তাদের দেহভঙ্গিতেই আছে একধরনের অসম্মান ও অবজ্ঞা করার ভাষা। তবে এদের দেখে সবাইকে যাচাই করা যাবে কি না, সেই সংশয়ও জাগল সেখানদার আলী নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব একজনকে দেখে। থাইংখালী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে স্থানীয় মুসল্লিদের সঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করে সবে বেরিয়েছেন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সেকান্দার আলী। কথা প্রসঙ্গে তিনি স্থানীয় বাঙালিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং তাঁদের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেন বলে জানালেন।

একই মনোভাব আমরা দেখেছি টেকনাফের জাদিমুরা ক্যাম্পে গিয়েও। মো. ইয়াছিন জানালেন, মা-বাবাসহ চার বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে এক বোন ও তাঁর স্বামীটি ছাড়া বাকি সবাই এ দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। এখানে আসার পর বিয়ে করেছেন ২০ বছর বয়সী এই তরুণ। স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ভালো বলে জানালেন তিনি। তবে ‘এখানকার লোকজন দুইটা খারাপ কথা বললেও শুনে না শোনার ভাব করে চলে যাই...’—এই কথার মধ্যে কোথাও যেন একটা অভিমান-অভিযোগের সুরও আছে। ছেলের কথায় সায় দিলেন ইয়াছিনের মা রাজুমা খাতুনও।

বোঝা গেল, দুই পক্ষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব একটা আছেই। কোথাও প্রকাশ্য, কোথাও গোপন। কোথাও আক্রমণাত্মক, কোথাও সমঝোতাপ্রবণ।

শুরুতেই বলেছি, স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হচ্ছে। বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য সতর্ক থাকতে হবে প্রশাসনকে। কোথাও কারও উসকানি আছে কি না, এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। সর্বোপরি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে চেষ্টা করতে হবে একটি সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করার। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের বিকল্প নেই।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক