চাই ভারসাম্যপূর্ণ সুশাসন

দুর্মুখেরা বলত, পদ্মা সেতু বলো আর মেট্রোরেলই বলো, ওসব স্বপ্ন, এ জনমে হচ্ছে না। দেখতে দেখতে স্বপ্নগুলো বাস্তবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আরও অনেক উন্নয়ন, অনেক অগ্রগতি, অনেক পুরস্কার। তথ্যপ্রযুক্তির সাফল্য। অন্যদিকে ১৭ কোটি মানুষের ছোট্ট ভূখণ্ডে উদ্বাস্তু ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়দানের অনন্য নজির। হরতাল, ভাঙচুর, মারামারি ও অচলাবস্থার অবসান। খালি চোখে সুখের সমুদ্র। 

কিন্তু দেশের বর্তমান অবস্থার বর্ণনায় একটি উদাহরণই যথেষ্ট আর তা হলো দুর্বৃত্তরা হত্যার উদ্দেশ্যে পুড়িয়ে দেওয়ার পর সোনাগাজীর নুসরাত জাহান যেদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে যান, সেদিন, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর স্প্যানটি বসানো হচ্ছিল। এটাই এ দেশের উন্নয়নের চিত্র। 

প্রদীপের নিচে অন্ধকার। এই যে স্মরণকালের সর্বোচ্চসংখ্যক ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা-আত্মহত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত ক্রসফায়ার, গুম, দুর্নীতি—অতীতের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে; এসবের কারণ কি কেবলই চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতা, বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা বা দীর্ঘসূত্রতা, লোভ ও অসম প্রতিযোগিতা? 

আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অন্যতম কারণ, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতি এসব সন্ত্রাসকে থামতে তো দিচ্ছেই না, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পরেও তদন্ত, মামলা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় কোনো শাস্তি দৃশ্যমান হচ্ছে না। দৈনিক পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৯৪২ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৭৩১ জন। 

অন্যদিকে ধর্ষণের মতো সড়ক দুর্ঘটনাও মহামারির আকার নিয়েছে। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৩২৯ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আস্তে আস্তে আরও অপকর্মের সর্প দিবালোকে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। ধর্ষণে যেমন প্রত্যক্ষভাবে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় এ ধরনের আরও অপকর্ম করে যাচ্ছে অন্য লম্পটেরা। দলীয় নেতাদের ঘর থেকে বের হচ্ছে শতকোটি টাকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ
অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্থা দুর্নীতি ও লুটতরাজের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। 

নতুন করে যুক্ত হয়েছে ক্যাসিনো। লাস ভেগাস আর ক্যাসিনো, এসব ছিল আমাদের কাছে অনেক দূরের অপরাধজগতের রূপকথা। অথচ আমাদের এই গরিব দেশেই এমন শতাধিক রূপকথা ঘাপটি মেরে ছিল আর কোনো দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার এত দিনেও এর সন্ধান পাননি, অবাক কাণ্ড! পাবেন কী করে? এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন উজিরপুত্র, নাজিরপুত্র, কোতোয়ালপুত্র মায় ওঝাপুত্র। সরিষার ভূত কে ছাড়াবে? 

প্রধানমন্ত্রী আগেও সতর্ক করেছেন। এবার একেবারে খড়্গহস্ত। এত কঠিন তিনি এর আগে হননি। আগাছা-পরগাছা উপড়ে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছেন। দুর্গতিনাশিনীর মতো অনাচার দমনে তাঁকে একাই লড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট বলেছিলেন, সেই সব জ্ঞানী রাজনৈতিক নেতার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, যাঁরা বোঝেন অধিকাংশ মানুষ রাজনীতি অপেক্ষা সরকারের কার্যকলাপে বেশি আগ্রহী। 

কিন্তু কেন এ অরাজকতা? এ রকম কি হওয়ার কথা ছিল? আসলে দেশে যে রাজনৈতিক শাসন বিরাজমান, তা যতটা না গণতান্ত্রিক, তার চেয়ে বেশি একদলীয়। একদলীয়তে একনায়কত্ব ভর করা স্বাভাবিক। নির্বাচনে একতরফাভাবে জিতে মনে করা হয়েছিল দেশে কোনো কোন্দল, সংগ্রাম, আন্দোলন, প্রতিরোধ, প্রতিহিংসা থাকবে না। অফিস-আদালত, মাঠঘাট, জনপদে কেবলই নিজেদের লোক। দলাদলির সুযোগ কোথায়? তাই ধর্ষণ-হত্যা যে করে, সে দলীয় লোক; সড়কে মানুষ মারছে দলীয় লোক; প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ দখল, দলবাজিতে দলীয় লোক; ভূমি, বন, বাড়ি, নদী দখলে দলীয় লোক; গুম-হত্যায় দলীয় লোক; ক্যাসিনোতে দলীয় লোক। কাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে? কে শাস্তি পাবে? দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য এসব দলীয় নেতা-কর্মীর ত্যাগ ও অবদানও তো কম নয়। তাঁরা প্রতিদান চাইবেন না? এটা তো কান টানলে মাথা আসার ফর্মুলা। 

ক্লাব আর ক্যাসিনোর পার্থক্য যাঁরা বোঝেন না, তাঁদের হাতে ঐতিহ্যের মৃত্যু অনিবার্য। যে ফুটবল ক্লাবগুলো একসময় সারা দেশের তরুণদের স্বপ্ন আর বিনোদনের আশ্রয়স্থল ছিল, তাতে এখন অবৈধ টাকা তৈরির মেশিন বনবন করে ঘুরছে। এসব আর কিছুই নয়, এর মূলে আছে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার থাবা। একটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ শক্তিশালী সমানে সমান সুষম বিরোধী দল গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। সাহিত্যের সমালোচনা যেমন সাহিত্যিকের মনন ও দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখে, তেমনি মুক্ত বিরোধী দলকেও ক্ষমতাসীনদের ভুল সংশোধনের আশীর্বাদ হিসেবে নিতে হবে। 

গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন অনেকটা ভবনের বাইরে সোনার জলে লেখা ওই সব ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের নাম, যার ভেতরে জুয়া-মদে ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। কঠোর হস্তে এসব অরাজকতা দমন সাময়িক স্বস্তি দিলেও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিশ্চিত ও ভারসাম্যের সুশাসন না আসা পর্যন্ত পরিস্থিতির কিছুই বদল হবে না। 

উম্মে মুসলিমা কবি ও কথাসাহিত্যিক 

muslima.umme@gmail,com