বাজি নিয়ে আড্ডাবাজি

দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের কাহিনিটি মহাভারতের কৃপায় আমাদের জানা। পাশা খেলায় দ্রৌপদীকেই বাজি রাখা হয়েছিল। তুমি আমার বায়ান্ন তাস শেষ দানেও রাজি, সারাক্ষণ এই গান আসে কানে। তাস খেলে কত ছাত্র পড়া নষ্ট করে, পরীক্ষা শেষ হবে চোখে জল ঝরে—কবিতায় পড়েছি।

তবে এখন টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্র খুললেই যা চোখে পড়ছে, তা যেন আমাদের মিউনিসিপ্যালটির ময়লার ভাগাড়ের মধ্যখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

ক্যাসিনো পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। আমেরিকায়, বিশেষ করে আদিবাসী এলাকায় আদিবাসীদের সচ্ছলতার জন্য ক্যাসিনোর অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। লাস ভেগাস কিংবা আটলান্টিক সিটি তো আছেই।

আমাদের দেশ মহান দেশ। আমরা সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকৃত—মদ, জুয়া, গণিকাবৃত্তি এ দেশে চলতে দেব না। এ প্রসঙ্গে আমার লেখাপড়া কম, কাজেই বেশি বলব না। বরং পুরোনো গল্প কিংবা কৌতুকগুলো আরেকবার ঝালাই করে নিই।

প্রথমেই বলি গোপাল ভাঁড়ের গল্পটা। এক মাঝি সারা রাত দাঁড় বেয়েছে। সকালবেলা ঘাটে পানি নিতে আসা এক রমণীকে সে বলল, ‘মা, এটা কোন ঘাট?’ নারীটি জবাব দিলেন, ‘হারামজাদা, নিজের বউকে মা বলো!’ তখন মাঝি খেয়াল করে দেখল, নৌকা ঘাটের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। সারা রাত সে পণ্ডশ্রম করেছে। নৌকা একচুল নড়েনি।

পরের কৌতুক একটি মানসিক হাসপাতালের। রোগী ভালো হয়েছে কি না, তার পরীক্ষা। একটা ড্রামের তলা নেই। ডাক্তার রোগীকে বললেন, এই ড্রাম পানি দিয়ে ভর্তি করো। রোগী সারা দিন-রাত পানি ঢালে, পাত্র ভর্তি হয় না।

তিনজন লোক তিনটা কুড়াল দিয়ে তিনটা গাছ কাটছে। দুজন গাছ কেটে ফেলল। একজন অনেক পরিশ্রম করল কিন্তু কিছুতেই গাছটা কাটা হয় না। বাকি দুজন সেই ব্যক্তিকে বলল, তোমার কুঠারে ধার দিতে হবে। লোকটা বলল, সময় নেই। সে আবারও চেষ্টা করছে। এখন এই সমস্যার দুটো সমাধান থাকতে পারে। কুড়ালটায় আসলেই ধার নেই, এটাকে ধারালো করতে হবে। আরেকটা ঘটনাও তো ঘটতে পারে। কুড়ালটার উল্টো দিক দিয়ে লোকটা গাছ কাটার চেষ্টা করছিল। ধারালো অংশটা গাছে না কুপিয়ে সে মোটা অংশটা দিয়ে কোপাচ্ছিল। যা-ই হোক না কেন লোকটার সমস্যাটাকে প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে এবং তারপর নতুনভাবে শুরু করতে হবে।

আমাদের দেশে এখন সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা অবস্থা। প্রাইমারি স্কুল, জুনিয়র স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো, আর আমরা অভিভাবকেরা সেই প্রশ্ন কেনার জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রশ্নপত্রের হাটে যেতাম। আমাদের বালিশের দাম লাখ টাকা, সেটা দোতলায় তুলতে আবার লাখ টাকা। আমাদের সড়ক নির্মাণের খরচ সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে লাখ লাখ টাকা দেওয়া-নেওয়া হয়। আমাদের ভূমি অফিসের সাব–রেজিস্টার কিংবা পুলিশের পোস্টিংয়ে কল্পনাতীত অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। আমাদের ছাত্রনেতারা গাড়ি-বাড়ি–ফ্ল্যাটের মালিক হন। আমাদের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সব অভিযোগ উত্থাপিত হয়। আমি টাঙ্গাইলের দিকে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। উপাচার্যের ঘরে দেখি ছাদ ভেঙে ভেতরের লোহা বেরিয়ে আছে। ঠিকাদার পুরোটাই মেরে দিয়েছেন। আর বখরা কি তঁাদের ওপরের কর্তারা পাননি?

এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ। দুধ আনতে বললে সবাই পানি আনবে, ওটা পানির পুকুর হয়ে যাবে। ছাত্রসংগঠনের পদ পেতেও নাকি লাখ লাখ টাকার হাতবদল হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’

তবু একটা কোথাও তো শুরু করতে হবে। একজন অন্তত বলুক, ঘুরে দাঁড়াও, এই অবস্থা চলতে পারে না।

রক্তের ভেতরে যদি দূষণ থাকে, চামড়ায় দাগ দেখা দিতে পারে। ক্যাসিনো হচ্ছে সেই দগদগে ক্ষত। সমাজদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূষণ।

শার্লক হোমস আর ডা. ওয়াটসন তাঁবুর নিচে শুয়ে আছেন। মধ্যরাতে শার্লক হোমস বললেন, ওয়াটসন, কী দেখতে পাচ্ছ? ওয়াটসন বললেন, আকাশে অনেক তারা।

এর মানে কী?

এর মানে, আগামীকাল রোদ উঠবে।

শার্লক হোমস বললেন, গর্দভ, আমাদের তাঁবু চুরি হয়ে গেছে।

আমাদের মাথার ওপর থেকে তাঁবু চুরি হয়ে গেছে, সমাজ থেকে মূল্যবোধ চুরি হয়ে গেছে, চোখ থেকে চুরি হয়ে গেছে পর্দা।

প্রতিরোধ প্রতিকার প্রতিবিধান শুরু করতে হবে।

শুরু যে হয়েছে, সেটাই সবচেয়ে ভালো কথা। আগে কেন হয়নি, ওদেরকে কেন, এদের কেন নয়, এভাবে বলতে চাই না। দুর্নীতি, বেআইনি কার্যক্রম, অপরাধ, অসামাজিক কাজকর্ম, সবই বন্ধ করতে হবে। চাই আইনের শাসন। চাই সুশাসন। সরকার কিন্তু বাজি নিয়ে একটা বাজি ধরেছে, দেখা যাক, ফলটা কী দাঁড়ায়!

শুক্রবারের সকালটায় নতুন আশায় বুক বাঁধতে চাই। কবি নাজিম হিকমতের ভাষায় বলতে চাই, যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর, তা আজও আমরা দেখিনি।

আমাদের সবচেয়ে সুন্দর শিশু আজও বেড়ে ওঠেনি। মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই, তা আজও আমি বলিনি।

আমি জানি, দুঃখের ডালি আজও উজাড় হয়নি কিন্তু একদিন হবে। দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষকে পৌঁছে দেবে মানুষ।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক