সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

সমন্বিত বা গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষা একটি বহু আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শুধু কৃষিবিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন গ্রহণও শুরু হয়েছে। যুগোপযোগী ও কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং প্রশংসনীয়। তবে যাদের জন্য এই পরীক্ষা পদ্ধতি, তারা সত্যিকার অর্থে এই কাঙ্ক্ষিত পদ্ধতির সুফল কতটুকু ভোগ করবেন, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

এই গুচ্ছপদ্ধতিতে আগামী ৩০ নভেম্বর স্নাতক প্রথম বর্ষের যে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে দেশের সাতটি কৃষিবিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এবারের ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আসনসংখ্যা মিলিয়ে সর্বমোট ৩ হাজার ৫৫৫ আসনের বিপরীতে পরীক্ষা দিতে পারবেন আসনসংখ্যার সর্বোচ্চ ১০ গুণ, অর্থাৎ ৩৫ হাজার ৫৫০ জন।

বিগত বছরগুলোতে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তির আবেদনের যোগ্যতায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট জিপিএ-৯ চাওয়া হলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জিপিএ অপেক্ষাকৃত কম থাকত। দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ স্নাতক শিক্ষাবর্ষে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মোট জিপিএ-৬, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৬.৫, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৭ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭.৫।

এ বছর গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মোট জিপিএর চতুর্থ বিষয় ছাড়া ৭। এতে যেসব শিক্ষার্থীর জিপিএ-৭-এর কম নিয়ে যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ হতো এবং কৃষিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, তাঁরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) ছাড়া বাকি পাঁচটিতে আগের বছরগুলোতে আবেদনকৃত যোগ্য সব শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকত। কিন্তু এ বছর নতুন গুচ্ছপদ্ধতির আওতায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সুযোগ রাখা হয়নি। যেখানে সাতটি কৃষিভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন, সেখানে মাত্র ৩৫ হাজার ৫৫০ জনকে (মোট আসনের ১০ গুণ) সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন আবেদনকৃত যোগ্য ভর্তি-ইচ্ছুক পরীক্ষার্থীদের আবেদন ফি নিয়ে তাঁদের নৈতিকভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে জিপিএ-৭ নির্ধারণ করা হলেও শুধু ১০ গুণ শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে কমপক্ষে জিপিএ-৯ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ ভর্তি-ইচ্ছুকদের আবেদনের যোগ্যতা কঠিন হওয়ায় বাকৃবি ছাড়া অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ নিয়ে কৃষিবিদ হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে।

উপরন্তু যে সমস্যাটি দেখা দেবে তা হলো, সামনের সারির (৯ বা ততোধিক) এসব শিক্ষার্থী ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাথমিকভাবে ভর্তি হলেও তাদের অধিকাংশের অন্যত্র ভালো কোথাও চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, ফলে আসনসংখ্যা খালি থেকে যাবে। যেখানে দেশে উচ্চশিক্ষায় আসনসংখ্যা সীমিত, সেখানে গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কমিটির এমন সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, যা নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং রাষ্ট্রীয় অপচয়ের শামিল। যেখানে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম, সেখানে প্রতি আসনের বিপরীতে মাত্র ১০ জন লড়াই করবে, যেটা আসলেই স্বপ্নের মতো। অথচ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি আসনের জন্য শতাধিক প্রার্থী লড়াই করে। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে থাকে। দ্বিতীয়বারের মতো এই গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকলেও ১০ গুণ বাছাই প্রক্রিয়ায় তাঁরা সুযোগ পাবেন না। সুতরাং সেখানে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকা আর না থাকা একই কথা। কৃষিভিত্তিক এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (বাকৃবি ও বশেমুরকৃবি) যদি বিগত বছরগুলোতে আবেদনকৃত যোগ্য সব শিক্ষার্থীর জন্য ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে, তাহলে এবার সাত বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিতভাবে কেন পারবে না—এ প্রশ্ন থেকেই যায়। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলো যদি ভর্তি-ইচ্ছুক সব প্রার্থীর জন্য ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে, তাহলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পারবে না।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের জিপিএর ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করে ১০০ নম্বরের (এমসিকিউ) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে পুনরায় একই জিপিএর জন্য আরও ১০০ নম্বর রেখে প্রার্থীর মূল্যায়ন কতটুকু যৌক্তিক, তা ভেবে দেখার অনুরোধ পরীক্ষা কমিটির কাছে। কারণ, এতে বেশি জিপিএ পাওয়া প্রার্থীরাই একই জিপিএর জন্য ডাবল বেনিফিট পাচ্ছেন, যা প্রকারান্তরে ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার গুরুত্বকে কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ প্রাপ্ত নতুন ও পুরোনো (দ্বিতীয়বার) আবেদনকারীরা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করলেও চান্স না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পরিবর্তে সরাসরি জিপিএর মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ দিলে অন্ততপক্ষে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যাতায়াত ভোগান্তি ও খরচটুকু কমে যেত এবং ভর্তিযুদ্ধের মানসিক চাপ থেকে শিক্ষার্থীরা বেঁচে যেতেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো অনুধাবন করা দরকার।

ভর্তি পরীক্ষায় বঞ্চিতদের আবেদনের টাকাটি ফেরত দেওয়া হবে কি না, তা উল্লেখ নেই বিজ্ঞপ্তিতে। বাকৃবিতে গত বছর বঞ্চিতদের টাকা ফেরত দিতে অনেক ভোগান্তি হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে এ বছর গুচ্ছপদ্ধতিতে বিপুলসংখ্যক বঞ্চিত শিক্ষার্থীর টাকা যদি ফেরত দিতে হয়, তা অনেক ঝামেলাপূর্ণ হবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। কারণ, আবেদনকৃতদের কোনো লিংক বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভর্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। আবার যদি টাকাটি ফেরত না দেওয়া হয়, তাহলে যে বিষয়টি দাঁড়াবে সেটি হলো, আগে যেখানে মাত্র একটি বা দুটি বিশ্ববিদ্যালয় তার আসনসংখ্যার ১০ গুণ বা ১৫ গুণ আবেদনকারীকে সুযোগ দিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করে যে টাকা আদায় করত, এখন এই গুচ্ছপদ্ধতিতে আরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হওয়ায় মোটা অঙ্কের টাকা আদায় হবে, যা নিঃসন্দেহে অনৈতিক। এ ছাড়া ভর্তি বাতিল করতে যে ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত বটে। 

ড. মো. সহিদুজ্জামান: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের অধ্যাপক
[email protected]