সৌদিতে নারী কর্মী নিগ্রহের শেষ কোথায়?

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী নিয়োগের জন্য দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায় গত বছর চারেকে কমবেশি ৩ লাখ নারী গৃহকর্মী সে দেশে কাজ করতে গেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই এরূপ কর্মীদের নিগৃহীত হয়ে দেশে ফিরে আসার খবর প্রকাশিত হয়। ফিরে এসে তাঁরা কখনো কখনো তাঁদের ওপর নির্যাতনের চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরেন। বিপুলসংখ্যক কর্মী অবশ্য রয়ে যান এবং চুক্তির মেয়াদ পূরণ করেন। অনেকে মেয়াদ নবায়ন করে আরও বেশি দিন থেকে যান পরিবার–পরিজনের জীবনে সামান্য স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখতে।

২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে একটি খবর দেখলাম, সৌদি আরব হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিয়োগ তারা বন্ধ করে দেবে। ফেরত আসা নারী গৃহকর্মীদের এরূপ অভিযোগ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসায় তাদের ‘সুনাম’ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বাংলাদেশ এর সুরাহা না করলে তারা একতরফাভাবে ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে, বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিনিধিদের ডেকে নিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে সৌদি শ্রম ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এ কথা জানিয়ে দেন।

বিষয়টি একদিক থেকে অভিনব। সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী প্রধানত যেত ফিলিপাইন থেকে। এই কর্মীদের ওপর অব্যাহত নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি সৌদিতে গৃহকর্মী প্রেরণে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। (২০১২ সালের এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, সৌদি আরবে কর্মরত ফিলিপাইনের নারী গৃহকর্মীদের ৭০ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়) এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিকল্প সস্তা উৎস হিসেবে সৌদি আরব বাংলাদেশকে নির্বাচন করে, যার ফলে ২০১৫ সালের চুক্তি। গত বছর ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া নারী গৃহকর্মীদের ওপর সৌদিদের নির্যাতন বন্ধে এবং তাঁদের অধিকার রক্ষায় নতুন করে চুক্তি সম্পাদনের দাবি জানিয়েছে। এ অবস্থায় সৌদি মন্ত্রিপ্রবরের এই হুমকি কতটা বাস্তবসম্মত, তা বিবেচনার দাবি রাখে।

এ বিষয়ে সৌদি আরবে আমাদের রাষ্ট্রদূত এবং জনশক্তি প্রেরণকারী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান বায়রার সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দিয়েছেন। দুজনের বক্তব্যে একটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যে নারী গৃহকর্মীরা সৌদি আরবে যাচ্ছেন কাজ করতে, তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। কথাটি অনেকাংশে সত্য। ৪০ বছর বিরামহীন অর্থ উপার্জনের পরও ক্ষুধা একটুও কমেনি অনেক জনশক্তি ব্যবসায়ীর। নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে আর দুই–দশটা আরবি শব্দ শিখিয়ে (কখনো তা–ও না করে) কোনোমতে বিমানে তুলে দিতে পারলেই তাঁরা তৃপ্ত। সৌদিতে পৌঁছে মেয়েগুলোর কী দশা হলো, তাতে তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই।

রাষ্ট্রদূত আরও বলেছেন, এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। পরিস্থিতিটা কী, তা অবশ্য তিনি স্পষ্ট করেননি। তা কী এই যে এখানে এলে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনকে মেনে নিতে হবে, এটা বুঝেই এখানে আসতে হবে?

পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, বায়রার সাধারণ সম্পাদক আরও একটি মন্তব্য করেছেন, যা চমকপ্রদ। তিনি বলেছেন, ‘সামান্য সমস্যা হলেই আমাদের কর্মীরা দেশে ফিরে আসেন। এ ধরনের সমস্যা দূর করার জন্য কর্মীদের পাঠানোর আগেই তাঁদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে।’ খুবই অবাস্তব ও অস্পষ্ট বক্তব্য। ‘সামান্য সমস্যা হলেই’ আমাদের কর্মীরা দেশে ফিরে আসেন না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। আমাদের কর্মীরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন যত দিন সম্ভব। সৌদি আরবে আমাদের বিপুলসংখ্যক কর্মী বাস করেন। তাঁদের অনেকেই ভালো আছেন (একটি প্রবল বৈষম্যপূর্ণ এবং অনেকটাই অধিকারবঞ্চিত পরিবেশে যতটা ভালো থাকা সম্ভব)। কিন্তু অনেকে ভালো নেই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, মানবেতর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে অনেকে বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছেন ফিরে যাওয়ার আগে আরও খানিকটা আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের জন্য। ‘সামান্য’ শব্দটা অবশ্য খুবই আপেক্ষিক। রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটি আমাদের পাঠ্য ছিল। শীতের সকালে গঙ্গাস্নান সেরে শীত নিবারণের জন্য কাশীর রানি পার্শ্ববর্তী এক দরিদ্রের কুটিরে আগুন লাগিয়েছিলেন। দরিদ্র প্রজার জীর্ণ বাসস্থানের এই অবসান তাঁর কাছে সামান্য ক্ষতি বলেই প্রতীয়মান হয়েছিল। ‘সামান্য সমস্যা’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন, তা স্পষ্ট করতে বায়রার সাধারণ সম্পাদককে অনুরোধ করব। মানসিকভাবে প্রস্তুত করার পাঠক্রমই–বা কী হবে?

দুঃখজনক হলেও সত্য যে সৌদি সমাজের একটা বড় অংশ এখনো মধ্যযুগের ধ্যানধারণা নিয়ে বাস করছে। যা কিছু আমার, তার ওপর আমার অধিকার নিরঙ্কুশ—এই প্রাচীন ধারণা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারেনি। একবিংশ শতাব্দীর বেতনভুক গৃহকর্মী আর মধ্যযুগের ক্রীতদাসের মধ্যে তফাত বুঝতে অনেকে অক্ষম। সৌদি রাষ্ট্র তাকে সেটা বোঝাতে খুব তৎপর, অবস্থাদৃষ্টে তা–ও মনে হয় না। সৌদি সমাজকল্যাণ (!) প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যে তারই প্রতিফলন দেখতে পাই।

আমাদের ৩ লাখ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে কাজ করছেন, এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরও কর্মী যাতে যেতে পারেন, তা–ও আমাদের দেখতে হবে। তবে যে নারী কর্মী সৌদি আরবে যাচ্ছেন, তাঁর শারীরিক, মানসিক ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাঠানোর আগে ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিন তাঁকে, পাঠানোর পর তাঁর নিরাপত্তার জন্য রক্ষাকবচ আরও দৃঢ় করুন। যে বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী সৌদি আরবের প্রয়োজন, তা দেওয়ার সামর্থ্য আছে শুধু তিনটি দেশের—বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপাইন (এবং হয়তো পাকিস্তান)। ইউরোপ–আমেরিকা থেকে এ কাজ করতে যাবেন না কেউ সৌদি আরবে। প্রতিযোগিতার মধ্যেও বেতন, কর্মঘণ্টা এবং কাজের পরিবেশ উন্নয়নে এই তিন দেশের মধ্যে সহযোগিতা সম্ভব হতে পারে। ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে গৃহকর্মীদের ন্যূনতম বেতন দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, যে কয়জন নারী কর্মী ফিরে এসে নির্যাতনের বিবরণ দিচ্ছেন, তাঁরা বিশাল হিমশৈলের ছোট্ট শিখর মাত্র। অনেক কান্না, অনেক দীর্ঘশ্বাস অবরুদ্ধ হয়ে আছে সৌদি ‘মালিক’দের অট্টালিকার বন্ধ দরজার আড়ালে।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব