এমন আশ্চর্য ভিসি... কীভাবে ছিলেন?

খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। ফাইল ছবি
খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। ফাইল ছবি

রাষ্ট্র ও সমাজবাস্তবতা এমনই দাঁড়িয়েছে যে কাকে ধন্যবাদ দেব? কোথায় স্বস্তি? কোথায় গণতান্ত্রিক অগ্রগতি? কখন কার কাছে কেন আমরা কৃতজ্ঞ থাকব, কোথায় থাকব না, সে বিষয়টি স্পষ্ট না।

অপসারণ না পশ্চাদপসরণ?
আমরা গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে বলছি। উপাচার্য রোববার রাতে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ উপাচার্য ছিলেন। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে বিএনপিপন্থী সোনালী দলের তিনি নেতা ছিলেন। গোপালগঞ্জের বিদ্যাপীঠের ভিসি হতে সে পরিচয় বাধা হয়নি।

দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে তাঁর খেতাব ছিল। কিন্তু তাতে রাষ্ট্র দমেনি। তাঁকে উপাচার্য করা হয়েছে। এখন তাঁর আকস্মিক প্রস্থানপর্ব কি কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থা নাকি কৌশলগত পিছু হটা? কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে নামা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পদক্ষেপ। তাঁর বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। ব্যক্তিগত অসুস্থতা দেখিয়ে তিনি ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।

দুর্নীতির আমলনামা: শিক্ষক নিয়োগ
গত কয়েক বছরে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক কী কী ঘটছে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নৈতিকতার বিকাশ ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সদাচার ও নৈতিকতা কাঙ্ক্ষিত ছিল, তার বিরাট ঘাটতি ছিল সেখানে। উপাচার্যের বিভিন্ন দুর্নীতির খবর সাম্প্রতিক কালে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ভিসির ভাতিজা একজন সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেলেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে তাঁর কোনো প্রথম শ্রেণি নেই। তা সত্ত্বেও তাঁকে সেকশন অফিসার থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যানের পদে বসানো হয়েছে। আরও অন্তত পাঁচজন শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। অথচ এ ধরনের চাকরিতে তৃতীয় শ্রেণী পাওয়া ব্যক্তির কোনো সুযোগ বিধিমতে নেই।

আক্কাস আলী নামের একজন ছাত্র ছাত্রত্ব শেষ না করেই অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক হন। মি. আক্কাস একই সময়ে একই বিভাগের চেয়ারম্যান ও ছাত্র। একই সময়ে তিনি একই বিভাগের পরীক্ষার্থী ও তার পরীক্ষকদের তদারককারী! ভিসি এটা মঞ্জুর করেছেন। আরও গুরুতর অভিযোগ, শিক্ষক হতে প্রার্থী হওয়ার সময় তিনি স্নাতকোত্তর পরীক্ষার (যা তিনি তখনও দেননি) ফলাফল উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর এই শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দুর্নীতির কোনো তুলনা হবে না। অভিযুক্তকে বাঁচাতেও কসুর করেননি তিনি। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেহেতু যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত, সুতরাং আজীবনের জন্য তাঁকে বিভাগের চেয়ারম্যানের পদে অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হলো। আর ছয় মাসের জন্য বরখাস্ত করা হলো শিক্ষকতা থেকে। এটা বুজরুকি। আমরা তাঁকে চাকরিচ্যুত করে ফৌজদারিতে সোপর্দ করার পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করি। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন বিশ্বের সেরা ১ হাজার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই, কেন তার কোনো সম্ভাবনাও নেই, তার জন্য দায়ি এধরনের ভিসিগণ।

উপাচার্য এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে চলছিলেন। আর সবই ঘটেছে মঞ্জুরি কমিশনের নাকের ডগায়। তাঁরা কেন আন্দোলনের আগে গোপালগঞ্জে গিয়ে দুই দিন কাটানোর দরকার মনে করেননি?

আর্থিক দুর্নীতি
ভিসির প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ, সেটা তো অতীতের খাম্বা, পারমাণবিক বালিশ, পর্দা কিংবা বনের রাজার বালিশ থেকে টাকা বেরোনোর গল্পকে হার মানিয়েছে। কয়েকটি বলি।

অভিযোগ অনুযায়ী, ৬০ হাজার টাকায় বনসাই গাছ কেনা হলো, দেখানো হলো সাত লাখ টাকা। অন্যদিকে বই কেনা বাবাদ খুলনা শিপইয়ার্ডকে দেওয়া হলো দুই কোটি টাকা। বই কেনার কাজ কী করে খুলনা শিপইয়ার্ড পেল? অথচ বইয়ের দেখা নেই। ভর্তিবাণিজ্য কত টাকার, তা জানা যায়নি। কিন্তু মাত্র দুই কোটি টাকার গোবরবাণিজ্য হয়েছে, সেটা আমরা শুনেছি। এই সব অদ্ভুত ও পিলে চমকানো অভিযোগের বিপরীতে আমরা কোনো দুদকীয় কার্যক্রম দেখিনি, কোনো বিভাগীয় তদন্ত দেখিনি। বরং ছাত্ররা জেগে ওঠা অবধি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি।

ব্যাখ্যা প্রয়োজন
যখন ছাত্রছাত্রীরা সন্ত্রাসীদের হাতে মার খেয়েছেন, নির্যাতিত ছাত্রী যখন ইউএনওর পা জড়িয়ে ধরেছেন, রক্তাক্ত শিক্ষার্থী যখন পুলিশের গাড়িতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, ভিসি যখন অসত্য তথ্য দিয়েছেন যে ক্যাম্পাসে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, তখন জেলা প্রশাসন গত ১১ দিনে আন্দোলনকারীদের পাশে তাঁদের নিরাপত্তায় কেন এল না, তার কোনো কৈফিয়ত কেউ কারও কাছে চাইছে না। বরং পুলিশ বলছে, তাদের কাছে অভিযোগ করা হয়নি বলে তারা মামলা করতে পারেনি, আসামি ধরা তো দূরের কথা। তবে সন্দেহ করি, ভিসি-সমর্থিত কোনো সংঘবদ্ধ বাহিনী, যারা জানে প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারবে না, তারা ওই হামলা চালিয়েছে। সমাজে বিকল্প বা সমান্তরাল সশস্ত্র শক্তির অশুভ উত্থানের পদধ্বনি কি শুনব আমরা? তারা আন্ডারগ্রাউন্ড শক্তি নয়, বুক চিতিয়ে প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়ানো শক্তি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেছে। তারা সেটা প্রকাশ করতে পারেনি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে, তারা সেটি প্রকাশ করতে পারেনি। তারা প্রতিবেদনটির জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু তদন্ত কমিটি যে জনগণের কাছে তা প্রকাশ করার মতো শক্তি রাখে না সেটা তাদের সীমাবদ্ধতা। এতটুকু স্বায়ত্তশাসন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নেই।

ধন্যবাদ বশেমুপ্রবি’র ছাত্রী ফাতেমাতুজ জিনিয়াকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী জাকারবার্গের ফেসবুকে এই নিরীহ প্রশ্ন তুলে বহিষ্কৃত হন। একটি প্রশ্ন একটি স্ফুলিঙ্গ। এই প্রশ্ন আজকের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাত্রাভেদে প্রাসঙ্গিক।

এই ভিসি যে মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, তার নানা মাত্রিক আইনি লঙ্ঘন রয়েছে। তিনি গুরুতর অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত বলেই প্রতীয়মান হয়। তাঁর আপত্তিকর কথোপকথনের অডিও বেরিয়েছে, তারপরও তিনি পদত্যাগ করেননি। তার থেকেও বড় কথা, সমাজে কণ্ঠস্বর যারা সরকারের প্রশাসনসংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠ, তারা একটি শব্দ খরচ করেনি। অবশ্যই আমরা সেই প্রতিবাদী প্রক্টরকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি ছাত্রদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে পদত্যাগ করেছেন।

আজ কিছুক্ষণ আগে ছাত্রছাত্রীরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সংগত কারণেই তাঁরা ভিসির কৌশলগত ক্যাম্পাস ত্যাগে উল্লসিত নন। লিখিত আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন পরিত্যাগ করবেন না।

অবশ্য আমরা এটাও লক্ষ করব যে খুলনা শিপইয়ার্ডকে কী করে দুই কোটি টাকা দিতে পারে, তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রশ্নে ছাত্ররা আন্দোলনে যেতে পারতেন। এই একটি ইস্যুতে তাঁরা কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি, সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁদের খুঁজে পেতে হবে। নির্যাতিত হওয়া তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। কিন্তু কেন তাঁরা শিক্ষা প্রশ্নে দুর্নীতি প্রশ্নে শক্তিশালী দুর্বার প্রতিরোধ গড়তে পারেননি!

যা কিছু বাকি রয়ে যাবে
আমরা সাধারণভাবে অবশ্যই অচলাবস্থার অবসান চাই। কিন্তু কিছু প্রশ্ন থাকবে, যার জবাব পেতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকতে হবে। কারণ, ভিসির অপসারণ সুশাসন আনবে না। এতে কৌশলগত মুখরক্ষা হবে। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন বা ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে থানার ওসিদের বদলি করা হয়। ভিসির অপসারণ সে রকম একটি বদলি। আমাদের সন্দেহ, তারই মহড়া চলছে। তাঁকে সরিয়ে দিলেই ছাত্ররা একটি গণতান্ত্রিক অর্জন বিবেচনায় আনন্দ মিছিল বের করবেন। তাঁরা বলবেন, সফল হয়ে তাঁরা হলে ফিরেছেন। কিন্তু সেটা একটা অধ্যায়। আসল অধ্যায় বাকি থেকে যাবে। যত দুর্নীতির অভিযোগ আছে, এসবের তদন্ত ও দ্রুত বিচার হবে না।

ভিসি নিঃসঙ্গ নন। তাঁর কীর্তি এখন একটা সিস্টেম। তিনি সিস্টেমকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এই সিস্টেমের পোশাকি আবরণটা সরকারদলীয়। কিন্তু ভেতরে সেটা দুর্নীতিগ্রস্ত। এর ভেতরে বিএনপি-জামায়াতসহ যত তন্ত্রমন্ত্র আছে, সবার পুনর্বাসন সম্ভব এবং সেটা ঘটছে। টাকার খেলা চলছে বাংলাদেশে। আর সে কারণেই একজন ভিসি কতটা নিরাপত্তা ও সুরক্ষা পেলে আট হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীর পেটের ভেতরে বসে তাঁদের মুখে দুই কোটি টাকার গোবর মেখে দিতে পারেন। একজন ভিসির কাজ এটা? একজন ব্যক্তির এতটা স্পর্ধা? ভিসির সরে যাওয়া তাই বৃহত্তর কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থের জলাঞ্জলি কি না?

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।
[email protected]