শুদ্ধি অভিযান থামানো যাবে না

দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর ঢাকার নামীদামি ক্লাবগুলোতে বেআইনিভাবে চালু হওয়া, পুলিশের নাকের ডগায় রমরমা ব্যবসা চালানো অনেক ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে র‍্যাবের অভিযান এবং ক্যাসিনো পরিচালনাকারী আওয়ামী যুবলীগের নেতার আসনে গেড়ে বসা ‘গডফাদারদের’ গ্রেপ্তার ও কোটি কোটি টাকার জুয়ার সরঞ্জাম উদ্‌ঘাটন প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। 

এর মধ্যে কয়েকজনের কাছ থেকে কয়েক শ কোটি টাকার এফডিআর ও বিপুল অঙ্কের নগদ টাকা পাওয়ার পর এই গডফাদাররা প্রকৃতপক্ষে কতশত বা হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন এবং কীভাবে, তা নিয়ে সবার মধ্যে প্রচণ্ড কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। এই গডফাদারদের সিংহভাগই বিএনপি ও ফ্রিডম পার্টি থেকে নাকি যুবলীগে ঢুকে পড়ে গত ১০ বছরে যুবলীগের প্রতাপশালী নেতা বনে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ অভিযানকে শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে শুরু হওয়া ‘শুদ্ধি অভিযান’ অভিহিত করেছেন। তাঁর দাবি, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চলতেই থাকবে এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এখন নাকি গোয়েন্দাদের নজরদারিতে রয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অদূর ভবিষ্যতে অভিযান পরিচালিত হবে। 

দেরিতে হলেও এই দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরু করার জন্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের যে অঙ্গীকার তিনি নির্বাচনের পর জাতির কাছে করেছিলেন, সেটার সত্যিকার বাস্তবায়ন শুরুর জন্য তাঁর প্রতি রইল শুভকামনা। বাংলাদেশের উন্নয়নের পথের ‘১ নম্বর বাধা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। এবার যদি এই দুটো জাতীয় মহাদুর্যোগের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে আরেকটি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সত্যি সত্যিই শুরু হয়, তাহলে এই যুদ্ধে আমরাও নির্দ্বিধায় শামিল হতে চাই। 

এই শুদ্ধি অভিযানে শেখ হাসিনার সাফল্যের জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি এ জন্য যে তিনি হয়তো এই অভিযানের মাধ্যমে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছেন। এ দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনকে রুখে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখানো সত্যি সত্যিই বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতোই। ভয় হয় যে এই শুদ্ধি অভিযানে হয় দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি লুটেরারা খতম হবে, নয়তো শেখ হাসিনাই তাদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন। 

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সমরপ্রভু জিয়াউর রহমান ও এরশাদ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এ দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁদের অবৈধ শাসনকে স্থায়ী করার প্রয়োজনে। আমরা যেন ভুলে না যাই, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পথ ধরে বাংলাদেশে আবারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পুরোনো পাকিস্তানি কায়দার সামরিক বাহিনী ও সিভিল আমলাতন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত নব্য ঔপনিবেশিক, আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজি লুণ্ঠনমূলক রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা। সুযোগ শিকারি ডানপন্থী ও বামপন্থী নেতা-পাতিনেতা-কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও সিভিল আমলা, পেশাজীবী এবং ব্যবসায়ীদের কেনাবেচার রাজনীতির মাধ্যমে অথবা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে জড়ো করে সেনানিবাসে বসেই জিয়াউর রহমান গড়ে তুলেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক দল বিএনপি। তিনি নিজে দুর্নীতি না করলেও তাঁর আমলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছিল। এ ব্যাপারে তাঁর আমল নিয়ে গবেষণা গ্রন্থের (বাংলাদেশ দ্য ফাস্ট ডিকেড) দুজন লেখকের কাছে তিনি খোলামেলা স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। এর এক লেখক কোসানেকের কাছে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জিয়া স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি অপরিহার্য বাস্তবতা (ফ্যাক্ট অব লাইফ)। কোসানেক বলছেন, ‘জিয়ার আমলে করাপশন ওয়াজ কনভার্টেড ফ্রম আ ক্রাইম টু আ হ্যাবিট।’ অপর লেখক মার্ক্স ফ্রান্ডার মতামত এ ব্যাপারে আরও খোলামেলা, ‘হোয়াট জিয়া হ্যাজ ডান ইজ টু রেগুলারাইজ করাপশন অ্যান্ড মেক ইট অলমোস্ট নেসেসারি ফর এভরিওয়ান টু বিকাম ইনভলড ইন ইট।’

১৯৫৭ সালে প্রকাশিত পল বারানের বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ পলিটিক্যাল ইকোনমি অব গ্রোথ-এ মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া (বা মুত্সুদ্দি পুঁজি) (comprador bourgeoisie) ও মুত্সুদ্দি সরকার (কম্প্রেডর গভর্নমেন্ট) ধারণাগুলো সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বারান ‘মুৎসুদ্দি পুঁজি’ কনসেপ্টটির সংজ্ঞা দিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নব্য ঔপনিবেশিক বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উন্নত শিল্পায়িত দেশগুলোর প্রচণ্ড শক্তিধর বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তৃতীয় বিশ্বের পুঁজিপতিদের ছোট তরফ বা এজেন্টের ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে ফোকাস করে। 

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইনডেন্টর, আমদানিকারক, সোল এজেন্ট, পরিবেশক, অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট স্থাপনকারী শিল্পপতি, ফ্র্যাঞ্চাইজি কিংবা সেলস এজেন্টের ভূমিকা পালনের মাধ্যমে যেসব বাণিজ্যনির্ভর পুঁজিপতি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মুনাফা আহরণে ব্যাপৃত থাকে, তাদেরই পল বারান মুৎসুদ্দি পুঁজির এই সংজ্ঞার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। আর আধিপত্য, পরনির্ভরতা সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নব্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় মুৎসুদ্দি সরকার বলা হয়েছে ওই সব রাষ্ট্রের সরকারকে, যেগুলো উন্নত পুঁজিবাদী দেশের ও তাদের তল্পিবাহক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ডিকটেশন মেনে চলে। সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের শাসনামলে তাঁদের দুজনেরই মার্কিন বশংবদতার কারণে এবং বৈদেশিক সহায়তার ওপর তখনকার বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বব্যাপ্ত নির্ভরতা হেতু তাত্ত্বিকভাবে তাঁদের নেতৃত্বাধীন সরকারকে মুৎসুদ্দি সরকার আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না।

১৯৭৫ সাল থেকে ৪৪ বছর ধরে বাংলাদেশে যে পুঁজিপতি গোষ্ঠীর বিকাশ হয়েছে, তাদের চরিত্র বর্ণনার জন্য মুত্সুদ্দি পুঁজি কনসেপ্টটি খুবই জুতসই। ১৯৭৫ সাল থেকে বর্ধিত বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ থেকে মার্জিন আহরণ এবং আমদানি–বাণিজ্যে বহুল প্রচলিত নানা পদ্ধতিতে এ দেশে পুঁজি লুণ্ঠন ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করতে শুরু করেছিল, যে প্রক্রিয়াগুলো স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার পর গত ২৮ বছর একই প্রক্রিয়াগুলো হুবহু চালু রয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল বা জোটগুলোর নেতা-কর্মীরা সরকারি প্রকল্পগুলো থেকে বেধড়ক পুঁজি লুণ্ঠন করেছেন। দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা অকার্যকর থাকায় এই ৪৪ বছর ধরে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিও পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে। এই সরকারব্যবস্থাকেই উন্নয়ন ডিসকোর্সে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বা চৌর্যতন্ত্র (ক্লেপটোক্রেসি) কিংবা ‘পুঁজি লুণ্ঠনমূলক সরকার’ (এক্সট্রাক্টিভ গভর্নমেন্ট) আখ্যায়িত করা হয়। তাই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ যে সুবিধাভোগীরা পুঁজি লুণ্ঠনের মহাযজ্ঞে শরিক হয়ে ‘গডফাদারে’ পরিণত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার দুঃসাহসই দেখিয়েছেন। এই দুর্বৃত্তরা সহজে চলমান ক্র্যাকডাউনকে মেনে নেবে না, তাই শেখ হাসিনাকে বিপদে ফেলতে তারা মরণকামড় দিতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু ওই ভয়ে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত এই শুদ্ধি অভিযান থামতে পারে না। এ দেশের কলঙ্কজনক দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের ইতিহাস বদলানোর গুরুদায়িত্ব শেখ হাসিনা অসমসাহসে তাঁর কাঁধে তুলে নিয়েছেন, জাতি তাঁর সঙ্গে থাকবে। 

শেখ হাসিনা ৭৩ বছরে পা রেখেছেন, আওয়ামী লীগের অন্যান্য বর্ষীয়ান নেতা-নেত্রীও বয়সের দিক থেকে ৭০ বা ৮০-এর ঘরে অবস্থান করছেন। তাঁরা যদি এ দেশের জনগণের মনে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আসন স্থায়ী করতে চান, তাহলে এই ‘শুদ্ধি অভিযান’কে বেগবান করার চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করা ‘ফরজ’ মনে করি। শেখ হাসিনা তাঁর সহকর্মীদের জন্য সুযোগটি সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যা হারানো দুর্ভাগ্যজনক হবে। এসব বর্ষীয়ান নেতা-নেত্রীর প্রায় সবাইকে তিনি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর গঠিত নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ঢালাও পরিবর্তনকে মন থেকে সমর্থন করতে পারিনি। গত মন্ত্রিসভার মধ্যে যাঁদের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে প্রশংসা, সুনাম ও শ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হয়েছে, তাঁদের মন্ত্রিসভা থেকে খারিজ করে দেওয়া আমার মতে অসমীচীন হয়েছে এবং তা জাতির জন্যও ক্ষতিকর হয়েছে। প্রবীণদের জায়গায় অপেক্ষাকৃত নবীনেরা মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেবেন সেটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু সে রদবদলটা হতে হবে ক্রমান্বয়ে। কিন্তু এবারের ঢালাও পরিবর্তনটা অনেকটা অমার্জিত গলাধাক্কা হয়ে গেছে! অন্যদিকে, বর্তমান মন্ত্রিসভায় যাঁদের ঠাঁই হয়েছে, তাঁদের কয়েকজনের অতীতের রেকর্ড মোটেও প্রশংসনীয় ছিল না। সে জন্যই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাঁরা নিজেদের কলঙ্ক কীভাবে আড়াল করলেন? ‘জিরো টলারেন্স’ তো ওখান থেকেই শুরু হওয়া উচিত ছিল, নয় কি? তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত ও জননন্দিত নেতা-নেত্রীদের প্রতি আমার আকুল আহ্বান, এই শুদ্ধি অভিযানকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করুন। 

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক