করুণা নয়, তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করুন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিশ্বব্যাপী সর্বত্র জন্মহার-মৃত্যুহার কমে আসার ফলে উন্নত এবং উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশেই বয়সকাঠামোয় পরিবর্তন আসছে। যার ফলে প্রায় সব দেশেই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯১১-৫১ পর্যন্ত প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের আশপাশে ছিল, ১৯৬১-৯১ পর্যন্ত ছিল ৫ ভাগের মতো, এরপর থেকেই দেশে প্রবীণের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ ভাগ এবং সংখ্যার দিক থেকে প্রায় দেড় কোটির মতো। জনসংখ্যা প্রক্ষেপণে দেখা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগের বেশি ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ থাকবেন, যাঁরা সংখ্যায় প্রায় সাড়ে ৪ কোটির কাছাকাছি হবেন।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শুধু যে প্রবীণের সংখ্যা বাড়বে তাই-ই নয়, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু গুণগত পরিবর্তনও আসবে, যেটি মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে। প্রথমত, ভবিষ্যতে মানুষের গড় আয়ু আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রবীণদের মধ্যে অতি প্রবীণ জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে বাড়বে। দ্বিতীয়ত, পুরুষের চেয়ে মহিলাদের গড় আয়ু বেশি হওয়ার ফলে প্রবীণদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি থাকবে এবং তৃতীয়ত, জন্মহার ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের সংখ্যা ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের চেয়ে বেশি হবে।

জাতিসংঘের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের সংখ্যা বাড়বে ২ দশমিক ৮ গুণ, সত্তর-ঊর্ধ্ব প্রবীণের সংখ্যা বাড়বে ৩ দশমিক ৬ গুণ এবং ৮০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণের সংখ্যা বাড়বে ৪ দশমিক ৫ গুণ।

ওপরের প্রেক্ষাপটে যেটি সুস্পষ্ট তা হলো ভবিষ্যতে প্রবীণদের নিয়ে আমাদের মোটা দাগে তিনটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, একটি হলো প্রবীণদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করা, দ্বিতীয়ত, বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে রোগশোকের প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রবীণদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা এবং তৃতীয়ত, বার্ধক্য, শারীরিক পরিবর্তন এবং রোগশোকের কারণে প্রবীণের একাংশ দৈনন্দিন জীবনযাপনে আংশিক বা সম্পূর্ণ অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন, এসব প্রবীণের ব্যক্তিগত সেবাশুশ্রূষা নিশ্চিত করা। এসব কিছুর জন্যই বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত অপ্রতুল। সরকার এবং নীতিনির্ধারকেরা এসব দিকে তেমন একটা মনোযোগ দিচ্ছেন বলেও মনে হয় না।

প্রবীণ বয়সে সুনির্দিষ্ট আর্থিক সুবিধা শুধু সরকারি চাকুরে এবং কিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন সুবিধার মাধ্যমে ভোগ করে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। অন্যদের মধ্যে সামান্য কিছুসংখ্যক হয়তোবা সারা জীবনের সঞ্চয় এবং সম্পদের ওপর ভর করে কর্মহীন জীবনের আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হন। কিন্তু প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বৃহদংশেরই কর্মহীন বেকার জীবনে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর কোনো আর্থিক সংগতি থাকে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম মেয়াদে ১৯৯৮ সালে প্রবীণদের আর্থিক দুর্দশা উপলব্ধি করে বয়স্ক ভাতার প্রবর্তন করেন।

এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ এই সুবিধা ভোগ করছেন। এমনকি চরম দরিদ্র প্রবীণদের মধ্যেও ভাতাভোগীর সংখ্যা মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমান বাজারদর এবং প্রবীণদের প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে ভাতার পরিমাণ মাসিক ৫০০ টাকা অত্যন্ত অপ্রতুল। তারপরও এই সামান্য আর্থিক সহায়তা ভাতাভোগী প্রবীণদের অনেক স্বস্তি এবং সহায়তা দিয়ে থাকে, তাই প্রবীণকল্যাণ নিশ্চিতে ‘বয়স্ক ভাতার ‘পরিধি এবং পরিমাণ দুটোই বৃদ্ধির দাবি রাখে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে গ্রামবাংলায় বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ প্রবীণই দারিদ্র্যসীমার নিচে বা তার আশপাশে বসবাস করেন এবং তাঁদের কোনো নগদ টাকার উৎসও নেই। সন্তানেরাও এখন আর আগের মতো মা-বাবার দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক নন। সাম্প্রতিক কালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামবাংলায় ২০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের ছেলেসন্তানদের মধ্যে ৬০ শতাংশই মা-বাবার দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক। ফলে কর্মহীন প্রবীণদের আর্থিক সহায়তা প্রদান একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়েও আমরা এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত মনোযোগ বা গুরুত্ব দিতে পারিনি। মেডিকেল কারিকুলামে জেরিয়াট্রিক মেডিসিন এখনো তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে প্রবীণের স্বাস্থ্যসমস্যা সম্পর্কে চিকিৎসকদের ধারণা ততটা সুস্পষ্ট নয় এবং এ বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ নেই বললেই চলে। হাসপাতালে ও চিকিৎসা গ্রহণে প্রবীণদের জন্য আলাদা বা বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে কোনো পৃথক বেড বা ওয়ার্ড নেই, এমনকি দেশের স্বাস্থ্যনীতিতেও প্রবীণদের স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।

প্রবীণদের ব্যক্তিগত সেবাশুশ্রূষার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের মধ্যে প্রায় ১১ ভাগ প্রবীণই বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে অন্যের ওপর নির্ভরশীল; সংখ্যায় যাঁরা প্রায় ১৫ লাখ বা তারও বেশি। এই প্রবীণেরা অন্যের সাহায্য ছাড়া খাওয়া, পরা, গোসল করা, কাপড় পরা, বিছানা করা, ইত্যাদি দৈনন্দিন কোনো কাজই করতে পারেন না এবং তাঁদের সেবাশুশ্রূষা অনেক সময় সাধারণ ব্যক্তিগত সেবাশুশ্রূষা থেকে শুরু করে চিকিৎসানির্ভর সেবাশুশ্রূষা পর্যন্ত হতে পারে। নানা কারণে পরিবার অনেক সময় এসব সেবা প্রবীণদের দিতে পারে না, আবার অনেক ক্ষেত্রে দিতে ইচ্ছুকও থাকে না। সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। কিছু এনজিও এবং ব্যক্তি প্রচেষ্টায় কেউ কেউ এ সেবাদানের প্রচেষ্টা নিয়েছেন, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। উপরন্তু, এসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বেশির ভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ায় সাধারণ লোকেরা এসব সেবা নিতে অপারগ থাকেন। ফলে এ ক্ষেত্রেও সরকারকেই উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে, প্রবীণের সংখ্যা আমাদের দেশে এই পুরো শতাব্দী ধরে বাড়তে থাকবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি পাঁচজনে একজন প্রবীণ থাকবেন। এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর কল্যাণ এবং মানবাধিকারকে অবহেলা করে এবং তাঁদের পেছনে রেখে দেশ উন্নতি এবং অগ্রগতির পথে বেশি দূর এগোতে পারবে না। তাঁরা আমাদের পরিবার ও সমাজেরই অংশ।

শরীফা বেগম: বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা ফেলো