থানায় হনুমান, মোরগের ডাক ও মানুষের বাক

রামায়ণের হনুমান ছিল রামভক্ত জীব। বাংলাদেশে হনুমান ভক্ত খুব পুলিশের। যশোরের কেশবপুরের হনুমান এ ব্যাপারে বিখ্যাত। অনুকরণীয় সেই ভক্তি ও বিশ্বাস। এক হনুমান–শিশু মানুষের পিটুনিতে আহত হলে হনুমান মাতার মনে যে ফরিয়াদ জাগে, তা জানাতে দলবল নিয়ে সে হাজির হয় স্থানীয় থানায়। ঠিক সে সময় গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের উপাচার্যকে ঘেরাও করে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। কেশবপুর বাজারের হনুমানরা সম্ভবত কোনো দোকানের টেলিভিশনে সেই মোক্ষম প্রতিবাদ পদ্ধতি দেখে থাকবে। কয়েক ঘণ্টা অবস্থান ধর্মঘটের পর যথেষ্ট প্রতিবাদ হয়েছে ভেবে তারা ফিরে যায়। অবশ্য তার আগে থানার পুলিশকে সুবিচারের আশ্বাস দিতে হয় হনুমানদের।

কিন্তু নির্যাতিত মানুষ কী করবে? আর সেই মানুষ যদি নারী হয়? এ ঘটনাও যশোরের। যাঁর স্বামী ফেনসিডিল মামলায় কারাগারে, রাতে তাঁর বাড়িতে পুলিশের এক এসআইসহ চারজন আসেন। তঁারা ওই নারীর কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিলে স্বামীর মামলা হালকা করে দেওয়া হবে, নইলে কেস হবে আরও জটিল। টাকা দিয়েও যদি কাজ না হয়? নারীর মনে এই সন্দেহ জাগায় মহাত্মনেরা ক্ষিপ্ত হন। পুরুষ খেপলে যুদ্ধও করে, আবার ধর্ষণও করে থাকে। চার বীরপুরুষের দুজন বাইরে দাঁড়িয়ে পরিবেশটাকে হইচইমুক্ত ও নিরাপদ করেন আর এসআইসহ আরেকজন ধর্ষণ করেন।

বাইবেলে আছে, এই–জাতীয় পাপের দোষে ঈশ্বর সোডোম ও গোমরাহ নামের দুটি শহর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু যত দূর জানি, মেয়েটির পিঠের তলার মাটি কাঁপেনি, তঁার ওপরের আকাশ থেকে বাজ পড়েনি ধর্ষক দুটির ওপর। কেউ আসেনি। স্বামী যঁার কারাগারে, সেই একাকী নারী পরদিন সকালে একাই উঠে দাঁড়ান। একাই যশোরের জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করান। পরীক্ষায় ধর্ষণের বিষয়টি প্রমাণিতও হয়, কিন্তু কে কে করেছে তা প্রমাণ করবেন আদালত।

কিন্তু ভয় হয় বরগুনার আয়শার ঘটনার মতো তদন্ত হয় কি না! ফেনীর নুসরাতের ক্ষেত্রেও শুরুতে তাই হয়েছিল। নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শার বাবা অভিযোগ করে যাচ্ছেন, পুলিশ অপরাধীদের সুরক্ষাতেই কাজ করেছে।

এসব দেখে দেখেই সম্ভবত রাজশাহীর কলেজছাত্রী লিজা পুলিশে ভরসা করতে পারেননি। গত শুক্রবার সকালে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার পর শাহ মখদুম থানায় গিয়ে হাজির হন বটে, কিন্তু পুলিশের কথায় ভরসা না পেয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু যাবেন কোথায়? শ্বশুরবাড়ির লোকজন স্থানীয় চেয়ারম্যানকে দিয়ে মেয়েটির মাকে ফোন করিয়ে বলায় যে স্বামীর বাড়ি গেলে তাঁকে মেরে ভ্যানে করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। থানায় গিয়েও ভরসা করতে পারেননি। বাড়ি ফেরার ভরসাও ছিল না, লিজা যে পালক! পালক মেয়ে হয়ে পরিবারের অমতে বিয়ে করার দোষে যে তিনি দোষী! শেষ ভরসা খুঁজতে গিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। সেখানেই হতাশ হয়ে তিনি কেরোসিন কিনে প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। সেই আগুন নিভলেও জ্বালা নেভেনি। দুঃখের জ্বালার চেয়েও বড় জ্বালা আগুনের জ্বালা। সেই জ্বালায় দিন কয়েক জ্বলতে জ্বলতে মেয়েটি মারা গেল। 

আরও ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল সেই নারীর, যাঁকে খুলনা রেলওয়ে (জিআরপি) থানায় নিয়ে আটকে ধর্ষণ করেন পাঁচ পুলিশ সদস্য। গত ২ আগস্ট বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেন থেকে ওই নারীকে আটক করে খুলনা জিআরপি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাতভর থানা হেফাজতে আটকে রেখে ওসিসহ পাঁচজন ধর্ষণ করেন। সেখানেই শেষ নয়। সকালে ওই নারীকে ফেনসিডিল পাচারের অভিযোগে আদালতে চালান করা হয়। ওসি-এসআইসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

মর্মান্তিক ক্ষতির মধ্য দিয়ে এই নারীরা জেনেছেন, হনুমান যা-ই বলে বলুক, থানা সব সময় ভরসার জায়গা নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গত বছরের জরিপ বলছে, ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ পুলিশের হাতে কোনো না কোনো ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ।

এই যে অবস্থা, সেটা বলা যাবে না। ফেসবুকে প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের হয়রানি-নির্যাতনের ভিডিও আসে। এখানে-সেখানে ভুক্তভোগী মানুষের আহাজারি শোনা যায়। কিন্তু সেটা বলার উপায় নেই। সম্প্রতি ফরাসি দেশে এক মোরগের ডাকস্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলন হয়ে গেল। ভোরবেলা মোরগের ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে এক প্রতিবেশী আদালতে মামলা ঠুকে দেন। খবরটি রটে গেলে ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ ওঠে। মোরগের ডাকার স্বাধীনতার পক্ষে গড়ে ওঠে জনমত। ফ্রান্সের ওই আদালত রায় দেন, মোরগের যখন-তখন ডেকে ওঠার স্বাধীনতা অবারিত থাকবে।

মোরগের ডাক মুক্ত সমাজের প্রতীক। এক পৌরাণিক গল্পে আছে, ভোরবেলা দেয়ালের ওপর মোরগ ডেকে উঠেছিল বলে, সেই ডাকে জনপদের মানুষের ঘুম ভেঙেছিল বলে তারা দেখতে পায়, বাইরের শত্রু আক্রমণ করছে। সঠিক সময়ে ঘুম ভাঙায় তারা আগাম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল।

বাংলাদেশে আমরা কি সেভাবে ডেকে উঠতে পারি? সঠিক সময়ে কি ঘুম ভাঙে আমাদের? ফ্রান্সের মোরগের ডাকস্বাধীনতা থাকতে পারে কিন্তু আমাদের মানুষের বাক্স্বাধীনতা আছে কি? ক্ষুব্ধ হনুমানের দল যতটা প্রতিবাদ করতে পারে, ততটা প্রতিবাদ কি বাংলাদেশে এখন করা যায়?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]