আইন কার্যকর না করেই সংশোধন?

বিষয়টি নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আসছে। যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন, ২০১৮ সালের অক্টোবরে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের খবরটি গুজব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত এ-সংক্রান্ত একটি উপকমিটি এর দায়িত্বে রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘স্টেকহোল্ডারদের’ দাবি ও পার্শ্ববর্তী দেশের আইন দেখে আইনটি সংশোধনের যৌক্তিক সুপারিশ করা হবে। জানা যায়, মালিক-শ্রমিকদের দাবির মধ্যে রয়েছে এ আইনের সব ধারা জামিনযোগ্য করা, সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের অর্থদণ্ডের বিধান বাতিল, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা ইত্যাদি। এ কমিটিতে সদস্য রয়েছেন আইনমন্ত্রী ও রেলপথমন্ত্রী। তবে এর বিগত সভায় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতিও উপস্থিত ছিলেন বলে পত্রিকার খবরে জানা গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাঁদের সুপারিশ জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে উপস্থাপন করা হবে। 

আইনটির সূচনা ২০১৮ সালের একটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন ছাত্র নিহত হওয়ার পরপর। তারা বাসের যাত্রী ছিল না। গাড়িটিও দুর্ঘটনায় পতিত হয়নি। কলেজ ছুটির পর বাড়ি ফেরার জন্য তারা ‘নিরাপদ ফুটপাতে’ বাসের অপেক্ষায় ছিল। চালকের সহকারী চালিত একটি বেপরোয়া বাস একরূপ হত্যাই করে দুটো তাজা প্রাণ। এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে। গত বছর সে ঘটনার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ফুঁসে উঠেছিল তরুণসমাজ। এ দাবির পেছনে সমর্থনও ছিল দেশবাসীর। 

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত চলমান ছিল সে আন্দোলন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সড়ক পরিবহন আইন নামে একটি আইন প্রণয়নেরও দাবি মেনে নেয়। তড়িঘড়ি করে পাসও হয়ে যায় আইনটি। সে বছরেই ৮ অক্টোবর গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তবে আইনে বিধান রাখা হয়, সরকার-নির্ধারিত তারিখ থেকে কার্যকর হবে এটি। তাই অনেকে আশঙ্কা করছিলেন পাস হওয়া অবয়বে আইনটি কার্যকর হবে না। তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দিতে এটা করা হলেও কার্যকর হবে প্রত্যাশার সঙ্গে বহু ফারাক রেখে। 

তড়িঘড়ি করে পাস করায় আইনে কিছু বিচ্যুতি থাকতে পারে। প্রয়োজনে সংশোধন হতে পারে। তবে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইনটি তখনই বলবৎ করে এর সুবিধা-অসুবিধা দেখা যেতে পারত। যে সংসদে এটি পাস হয়, সে সংসদে তো পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও পরিবহন মালিক সমিতি, উভয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতিরা সদস্য ছিলেন। তাঁরা তখন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রিসভা বা সংসদে তাঁরা তখন ভিন্নরূপ কোনো বক্তব্য দিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। আর সড়ক পরিবহনব্যবস্থার তাঁরাই শুধু স্টেকহোল্ডার নন। 

যাত্রী ও পথচারীদের প্রতিনিধিত্ব কোথায়? যদি ধরে নেওয়া হয় মন্ত্রী–সাংসদেরা সবারই প্রতিনিধি, তাহলে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের আলাদা সত্তাও বিবেচনায় নেওয়া যায় না। হতে পারে যাত্রী ও পথচারীদের কোনো সংগঠন ব্যাপক ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব করে না। তবু কিছু আছে। তদুপরি সুশীল সমাজ এ ব্যাপারটায় সংশ্লিষ্ট হতে আগ্রহী হবে। সংশোধন প্রক্রিয়ায় তাদের সংশ্লিষ্ট করা যায়। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সুপারিশ প্রণয়নে তাঁরা স্টেকহোল্ডারদের দাবি ও পার্শ্ববর্তী দেশের আইনকানুন বিবেচনায় নিয়েছেন। পরিবহনশ্রমিক ও মালিকদের সমাজে প্রয়োজনীয়তাও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করি। তবে তাঁদের কেউ কেউ যাত্রী ও পথচারীর প্রতি আদৌ সংবেদনশীল নন। এমনকি এখনো যে আইন আছে, তা-ও যতটা সম্ভব তাঁরা অবজ্ঞা করেন। তাঁদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ বিশাল পরিবহনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য রাখে না। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকাও ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ। মূলত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে পুলিশের ওপর। পরিবহন সেক্টরের স্পর্শকাতরতার বিষয়টি পুলিশও জানে। তদুপরি একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁদের সমঝোতাও গোপনীয় কিছু নয়। স্বর্ণডিম্ব প্রসবিনী এ খাতকে এভাবে টিকিয়ে রাখলে অনেকেরই লাভ। অবশ্য তাঁদের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাধন্য গডফাদাররাও আছেন। 

পার্শ্ববর্তী দেশের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যের যে কথা বলা হলো, তা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। গত ২৩ জুলাই ২০১৯ হাইকোর্টে বিআরটিএ পেশকৃত এক তথ্যানুসারে, রেজিস্ট্রিকৃত গাড়িগুলোর মধ্যে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২৫টির ফিটনেস হালনাগাদ করা হয়নি। এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে একজন সদস্য তথ্য দিয়ে উল্লেখ করেছেন, রেজিস্ট্রিকৃত যানবাহন আছে ৩৮ লাখ। আর চালক ২০ লাখ। বাকি ১৮ লাখ গাড়ি কে চালান? এমন চিত্রটি পার্শ্ববর্তী দেশের কোন রাজ্যে আছে! এ অবস্থাকে কি পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য বলে আখ্যায়িত করলে দোষণীয় হবে? আর সে ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে আমরা তাদের আইন তলিয়ে দেখব কেন? এ খাতকে তলিয়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার করতে একটি শক্ত আইন সবাই চায়। স্থগিত হয়ে সংশোধনীর অপেক্ষায় থাকা আইনটি অনেকটা এ ধরনের। 

 আমরা যতটুকু জানি, চালকদের লাইসেন্স-সংকট কাটাতে এরই মধ্যে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেমন যাঁদের এখন হালকা ও মাঝারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে, তাঁদের এ ধরনের গাড়ি এক বছর চালালেই পরবর্তী ধাপের লাইসেন্স পাওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন। অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকবে। তবু আমরা ব্যবস্থাটিকে মন্দের ভালো বলব। লাইসেন্সবিহীন বা ভুয়া লাইসেন্সধারী লোক গাড়ি চালান, ক্ষেত্রবিশেষে চালান চালকের সহকারী, সে ক্ষেত্রে একটু নিয়মকানুনের মধ্যে আসবে। তবে ব্যবস্থাটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার সুযোগ নেই। অভিজ্ঞতার নেই কোনো বিকল্প। ব্যবস্থাটি চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানা যায়। এতেও ১৮ লাখ চালকের ঘাটতি মিটবে না। চালক আছেন। চালাচ্ছেন কোনো না কোনো গাড়ি। তাঁদের লাইসেন্সের আওতায় নেওয়ার জন্য স্থগিত করে রাখা সড়ক পরিবহন আইনের কঠোর বিধানাবলি কাজে লাগত। সংশোধনী যদি হয়, তবে তা কী আকারে পাস হয়, সে বিষয়ে আগ্রহী রইলাম। আর তা যদি না-ই হয়, তবে এটাকে কার্যকর করা হচ্ছে না কেন? 

পরিবহন খাতের শৃঙ্খলার বিষয়ে সরকার আপসহীন মনোভাব নিলে আইনের কিছু প্রান্তিক সংশোধনী এনেও মৌলিক চেতনা ঠিক রাখা যায়। পরিবহন সেক্টরকে বুঝতে হবে, তাদের অবস্থান সরকারের ঊর্ধ্বে নয়। কথায় কথায় সড়ক ধর্মঘট করে জিম্মি রাখা যাবে না জনগণকে। এমনটা না হলে পাস হওয়ার পর আইনটি হিমাগারে পড়ে থাকত না। পরিবহন সেক্টর কীভাবে দাবি করে আইনের সব অপরাধ জামিনযোগ্য হতে হবে! এটা আইনের মৌলিক চেতনার বিরুদ্ধে যাবে। আইনের বিধানে এটাকে জামিন অযোগ্য বলা হলেও সংশ্লিষ্ট বিচারক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় নিয়ে জামিন দিতে পারেন। যেমন দেন দণ্ডবিধির মামলায়। চালকদের জরিমানার পরিমাণ কমানোর দাবি তাঁরা করতে পারেন। বিধানটি বাতিল করতে হবে কেন? লাইসেন্স দেওয়ার শর্ত কতটাই-বা শিথিল করা যায়। এখনো কার্যত একপ্রকার অল্প শিক্ষিতরাই লাইসেন্স পাচ্ছেন। এখানে দরকার রয়েছে একটু লেখাপড়া জানা লোকের। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। মালিকদেরও কিছু শাস্তির ব্যবস্থা আইনটিতে আছে। জেনেশুনে লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তির হাতে গাড়ি তুলে দিলে সে চালকের দ্বারা সংঘটিত দুর্ঘটনার দায় মালিককে অংশত বহন করতেই হবে। 

এ সেক্টরের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক বলা ও লেখা হয়। প্রতিদিন দুর্ঘটনায় লোক মরছে। বেপরোয়া গাড়িচালক ট্রাফিক সার্জেন্ট ও কনস্টেবলকেও চাপা দিয়ে পালিয়ে যান। সড়ক পরিবহন আইনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশোধন হলেও এর চেতনার সঙ্গে যেন কোনোভাবেই আপস করা না হয়। তবে কার্যকর করতে আরও অধিকতর বিলম্বও আইনটিকে তাচ্ছিল্য করার নামান্তর। 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব