গিটারের তারে বিপ্লব ডাকো, গুরু

জেমস। ফাইল ছবি
জেমস। ফাইল ছবি

জীবনে খুব কম কনসার্টেই আমি অংশ নিতে পেরেছি। এটা আমার একটা বড় দুর্ভাগ্য। তবে যে কয়টা কনসার্টে আমি গিয়েছি, তার মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার অভিজ্ঞতার একটি ছিল জেমসের কনসার্ট। সালটা ছিল ২০১৬। আমি আর আমার এক বন্ধু চট্টগ্রাম শহরের আজিজ স্টেডিয়ামে কনসার্ট শুনতে গেলাম। আমি দেশে এসেছিলাম শীতের ছুটিতে। অনেক দিন কনসার্ট দেখিনি, তাই গেলাম। জেমসের গান শুনতেই যে সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম, সে কথা বললে ভুল হবে।

জেমসকে আমি চিনতাম। অবশ্যই চিনতাম। তাঁর গান পছন্দ করতাম। তাঁর ‘মা’ গানের দরদ আর ‘আমার সোনার বাংলার’ শক্তি আমাকে টানত। ‘তারায় তারায় রটিয়ে’ দেওয়ার শপথ আমার অন্তর ভরিয়ে দিত। তবে কখনো ঠিক বুঝে উঠিনি তাঁর কণ্ঠের, তাঁর শিল্পের শক্তিটা ঠিক কোথায়, ঠিক কতটা। বুঝলাম সেদিন, সামনাসামনি তাঁর গান শুনতে গিয়ে।

সেদিন পরপর অনেকগুলো ব্যান্ড উঠে গাইল। আমার প্রিয় কিছু ব্যান্ডও ছিল। লিরিকস ছিল জানা। সেসব গানের তালে আমরা মাথা নাড়লাম, একটা-দুইটা গাইলামও। বেশ ভালো লাগছিল। উত্তেজনা অনুভব করছিলাম।

এরপর নেওয়া হলো একটি ছোট্ট বিরতি। চারিদিক গমগম করতে লাগল। সবাই থমথমে হয়ে বসে টান টান উত্তেজনায় অপেক্ষা করছে। কিছু একটা হচ্ছে, কিছু একটা হচ্ছে! কেউ একজন আসছেন মঞ্চে! খুব বড় মাপের কেউ।

তারপর স্টেজের সব সাউন্ড মনিটর এনে গোল করে রাখা হলো ভোকাল মাইকের চারদিকে।

এরপর দৃপ্ত পদক্ষেপে তিনি মঞ্চের ঠিক মাঝখানটায় এসে দাঁড়ালেন। দুই হাত জড়ো করে ওপরে তুলে রাখা, যেন তাঁর শ্রোতাদের বন্দনা করছেন তিনি।

আর সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের আজিজ স্টেডিয়ামে দপ করে আগুন ধরে গেল। রক্তের প্রতিটি দানা কেঁপে উঠল আমার, আমার বন্ধুর এবং অচেনা হাজারো মানুষের। হয়তো এই সেই অনুভূতি যার জন্য মানুষ শিল্প করে, গান গায়, ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, রাজনীতি করে। এই সেই অনুভূতি, যাকে একটিবার পাওয়ার জন্য মানুষ নিশ্বাস নেয়।

গনগনে স্টেডিয়াম তখন কাঁপতে থাকল এক অবিচ্ছেদ্য ধ্বনিতে, ‘গুরু, গুরু, গুরু’।

সত্যিকারের নেতাদের যেমন নিজেকে নেতা দাবি করার প্রয়োজন পড়ে না, জেমসকেও কখনো দাবি করতে হয়নি যে তিনি বাংলাদেশের রকসংগীতের গুরু। তবে জনতা তাঁকে এই নাম দিয়েছেন পরম ভালোবাসায়।

একেই বলে সত্যিকারের ক্ষমতা। এই ক্ষমতার জন্য কাউকে জোর করতে হয় না, কাউকে অত্যাচার করতে হয় না, রগ ফুলিয়ে স্লোগান দিতে হয় না, মিথ্যে ইতিহাস আর কল্পিত পরিসংখ্যান আওড়ানো লাগে না। কেবল জনতার মঞ্চে দাঁড়ানো লাগে। আর জনতাই নিজে থেকে কেঁপে ওঠে, ‘গুরু, গুরু, গুরু’।

আপনারা হয়তো ভাবছেন একজন ছাপ্পা মারা রাজনৈতিক লেখক হয়েও একজন সংগীতশিল্পীকে নিয়ে কেন কথা বলছি। বলছি কারণ মুক্তি মানে শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়। মুক্তি মানে সামাজিক মুক্তি, মূল্যবোধের মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি। সেগুলোর অনেক দিক দিয়ে জেমস এবং তাঁর সমসাময়িকেরা ছিলেন মুক্তির মশাল।

যে সময়ে তাঁরা রকসংগীত গাওয়া শুরু করেছিলেন, তখন তাঁদের আখ্যা দেওয়া হয়েছিল অপসংস্কৃতি হিসেবে। তাঁরা মদ, গাঁজা, ড্রাগসে মেতে থাকেন, এমনটা বলা হতো। অনেকে বলতেন, তাঁরা দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেবেন। এবং এই কথাগুলো অনেক নাকউঁচু মানুষ এখনো বলেন।

তবু জেমস থামেননি। জেমসরা থামেন না। তাঁরা সমাজকে পরিবর্তন করেছেন, সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, সংস্কৃতি আলমারিতে তুলে রাখার জিনিস নয়। সংস্কৃতির ধর্মই হলো পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং আধুনিকায়ন। যাঁরা বলতেন রকসংগীতে মাধুর্য নেই, তারা কি ‘মা’ গানটির দরদ শুনেছেন। যাঁরা বলতেন রক বৈদেশিক আগ্রাসন, তাঁরা কি শুনেছেন ‘আমার সোনার বাংলা’? তাঁরা কি শুনেছেন জেমসের কনসার্টে হাজার জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ঐকতান? তাঁরা কি দেখেন যে বাংলাদেশের হাজার যুবক-যুবতীর অন্তরে তথাকথিত মূলধারার বাংলা সংস্কৃতির চেয়ে অধিকতরভাবে জায়গা করে নিয়েছে নতুন ধারার সংগীত।

সাংস্কৃতিক শুদ্ধতাবাদীরা হয়তো এখন গোসসা করে ঘাড় ফুলিয়ে বলতে আসবেন যে নতুন যুগের ছেলেপেলে বিপথগামী হয়ে অপসংস্কৃতি বেছে নিয়েছে। এখানেই সাংস্কৃতিক শুদ্ধতাপন্থীদের বড় ভুল। সংস্কৃতির কোনো বিপথ নেই আর অপসংস্কৃতি বলতেও কিছু নেই। কেবল সেই সংস্কৃতিই খারাপ, যেটি অনুদার এবং মারমুখী। তবে সংস্কৃতি যদি বদলের দিকে যায়, তাতে যদি মিশ্রণের ছোঁয়া আসে, তবেই তাকে অপসংস্কৃতি বলে ঘোষণা করতে হবে, এটা একটি চরম ভুল পথ।

সতীদাহ প্রথা আমাদের অতি সযত্নে লালিত স্বদেশি সংস্কৃতি ছিল। কই, উৎসের দোহাইয়ে সেটি কি ঐতিহাসিকভাবে অপসংস্কৃতির তকমা পাওয়া থেকে বাঁচতে পেরেছে? তবু ঘাড় বাঁকা করে উদারবাদী খোলসের সাংস্কৃতিক শুদ্ধতাবাদীরা তথাকথিত ‘বিদেশি’ সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতির আখ্যা দেন এবং খাঁটি রক্ষণশীল মনোভাব গড়ে তোলেন আর নিজেদের আভিজাত্যের দালানকে তরতরিয়ে তোলেন।

অথচ সংস্কৃতির সৌন্দর্য এবং শক্তির উৎস হলো মিশ্রণে। মিশ্রণের ফলে সংস্কৃতি হয় যুগোপযোগী, ব্যবহার্য। যে সাধুভাষাকে এককালে ‘গুরু’ আর চলিত ভাষাকে ‘চণ্ডালী’ বলে একসময় বর্ণনা করা হতো, তাদের মাঝে কোনটি টিকে আছে? টিকে গেছে জনমানসের চণ্ডালী আর সাধুবাবা জাদুঘরে উঠেছেন।

ঠিক একইভাবে নতুন যুগের জনমানসে স্থান করে নিয়েছে জেমসের গান। তাঁদের গানের ধরনের মাধ্যমে যে নতুন সংগীত ঘরানা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে সেটি আজ এই অঞ্চলের মাঝে অন্যতম। জেমসদের দেখানো পথে হেঁটে আজ বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে শত শত নতুন ব্যান্ড। প্রতিবছর রচিত হচ্ছে অসংখ্য নতুন গান। সেই সব গান বাংলার ইতিহাসকে, ঐতিহ্যকে নতুন যুগের কাছে উপস্থাপিত করছে এবং রচনা করছে নতুন যুগের সমসাময়িক ইতিহাস। এই যদি সংস্কৃতির মূলধারা না হয়, তবে মূলধারা কোনটি? যে ধারাটি জাদুঘরে মাকড়সার জালে জড়াচ্ছে, সেটি?

ভেবে দেখুন, যদি আমরা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদীদের কথা শুনে জেমসদের চুপ করিয়ে দিতাম, তবে কি আমরা কোনো দিনও সংস্কৃতির এই নতুন মাত্রাটি খুঁজে পেতাম?

জেমস এবং জেমসদের সংগীত ঠিক এই ব্যাপারটিই আমাদের শেখায়। প্রবহমান সংস্কৃতি একটি চলমান নিরীক্ষা। তার মাঝে যত উপনদী শাখা নদী প্রবেশ করবে, ততই মূল নদীটি ফুলেফেঁপে উঠবে এবং সবাই গিয়ে মিশবে সেই এক অভিন্ন বিশ্ব সংস্কৃতির সাগরে।

জেমসের সংগীত এবং তাঁর জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে যে আমাদের নদীটি, যেটিকে আমরা বাঙালি ও বাংলা সংস্কৃতি বলে ডাকি, সেটি কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে না, বরং কালের স্রোতে ভেসে বারংবার নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পাবে। তাই জেমসের গানে, জেমসদের গানে আমাদের জন্য একটি বার্তা রয়েছে। বার্তাটি পরিবর্তনের, বার্তাটি বিপ্লবের।

জেমস আমাদের শেখান, বিপ্লব করতে সব সময় অস্ত্র বা প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নামতে হয় না, অনেক সময় আঙুল রাখতে হয় গিটারে।

গতকাল আপনার জন্মদিন ছিল। আপনাকে জানাই বিলম্বিত শুভেচ্ছা, গুরু।

অনুপম দেবাশীষ রায়: ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদকীয় ও কলাম বিভাগের একজন উপসম্পাদক।