শ্যামাসুন্দরী কি অতীত সৌন্দর্যে ফিরবে

রংপুর শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে শ্যামাসুন্দরী নদী (খাল হিসেবে প্রচলিত)। ১৮৯০ সালে তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকী বল্লভ সেন নদীটি পুনঃখনন করে তাঁর মায়ের নামে নামকরণ করেন। পুনরায় খননের ১৩০ বছর হলো। ১৩০ বছর পর আবারও শ্যামাসুন্দরী প্রধানত আলোচনায় এসেছে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে। গত ২৬ আগস্ট রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে ‘শ্যামাসুন্দরী খাল পুনরুজ্জীবন ও সচল রাখা: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক একটি সভা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। 

ওই সভায় রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র, জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তা এবং রংপুরের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। রংপুর সিটি করপোরেশনের সচিব রাশেদুল হক প্রজেক্টরের মাধ্যমে শ্যামাসুন্দরীর অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে একটি ধারণা উপস্থাপন করেন। রাশেদুল হক উল্লেখ করেন, ২০০৭-২০০৮ সালে শ্যামাসুন্দরী দখলদারদের একটি তালিকা জেলা প্রশাসন প্রণয়ন করেছিল। সেখানে ৪৩২ জন দখলদারের তালিকা পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা যে আরও অনেক বেড়ে গেছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নদীর পাশে কয়েক শ বাড়ির পয়োনিষ্কাশনের সংযোগ নদীতে যুক্ত করা হয়েছে। 

উপস্থিত সুধীজনের মধ্যে রংপুরের সাংস্কৃতিক-সামাজিক কাজে নেতৃত্ব দেন এমন কয়েকজন ব্যক্তি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁরা মনে করেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এককভাবে এ নদীর কাজ করলে কোনো অবস্থায় এ কাজ যথাযথ হবে না। উপস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও তাঁদের স্বচ্ছতার পক্ষে মত তুলে ধরেন। রংপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি রশিদ বাবু বলেন, কয়েক বছর আগে শ্যামাসুন্দরীর উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এই প্রকল্পই অভিশাপে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে এর উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। 

প্রকৃত অর্থে রশিদ বাবুর কথা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। সরকার প্রায় ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল খনন এবং দুই পাড়ে পথচারী হাঁটার জন্য পাকা সড়কের লক্ষ্যে। যে বছর কাজ শেষ হয়েছে, সেই বছরেই অসংখ্য স্থানে ভেঙে পড়েছে পাড়। ওই সময় সবচেয়ে বড় সর্বনাশ হয়েছে শ্যামাসুন্দরীর সীমানা চিহ্নিত না করেই দখলদারদের নিরাপদ রেখে বিদ্যমান নদীর দুই পাড় পাকা করা। নদীটি খননের জন্য নতুন করে প্রকল্প সরকারিভাবে অনুমোদিত হয়েছে। ১৯৪০ সালের ভূমি নকশা ধরে সীমানা নির্ধারণ করা হলে দেখা যাবে, নদী বর্তমান অবস্থানের চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ত। তাহলে কয়েক বছর আগে যে পাড় বাঁধাই করা হয়েছে, তার অবশিষ্ট অংশটুকুও ভেঙে ফেলতে হবে। রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমানও আগের প্রকল্পকে আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করেছেন। 

বর্তমানে শ্যামাসুন্দরী চরম দখল-দূষণের শিকার। রংপুর সিটি করপোরেশন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কম দায়ী নয়। ২৬ সেপ্টেম্বরের সভায় চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী মফিজুল ইসলাম বলেন, গার্বেজ এবং ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ঠিকভাবে হচ্ছে না। শ্যামাসুন্দরী–দূষণের কারণে শুধু ডেঙ্গুর ভয় আছে তা নয়; ম্যালেরিয়া, অ্যালার্জিসহ অনেক রোগের উৎস এটি। রংপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র এ কে এম আবদুর রউফ বলেন, ‘১৩ বছর আগে আমার মেয়াদে কেরামতিয়া মসজিদের পাশে শ্যামাসুন্দরীর পাড় বাঁধাই করে শোভাবর্ধনের কাজ করা হয়েছে। ওই মডেল অনুসরণ করে সম্পূর্ণ শ্যামাসুন্দরীকে সাজানো যেতে পারে।’ সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বলেন, ‘টুকরো টুকরো প্রকল্প গ্রহণ করে শ্যামাসন্দুরী বাঁচানো যাবে না। এর জন্য বড় প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।’ সেনাবাহিনীকে দিয়ে নদীর দখল উচ্ছেদ করতে হবে—এই পরামর্শ দিয়ে সংবাদকর্মী মেরিনা লাভলী বলেন, আজ এখানে যে সভার মাধ্যমে শ্যামাসুন্দরী রক্ষার কাজ শুরু হলো, তা যেন থেমে না যায়। রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, ‘আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর রংপুরের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলাম। সেদিন সুধীজন সবচেয়ে বেশি দাবি জানিয়েছিলেন শ্যামাসুন্দরী রক্ষার। শ্যামাসুন্দরী আমাদের রক্ষা করতে হবেই।’ 

মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘সবার আগে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রংপুরের প্রতি খুবই আন্তরিক। শ্যামাসুন্দরী নিয়ে যত বড় প্রকল্পই হোক, তিনি অনুমোদন দেবেন। আমরা এমন কাজ করতে চাই, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের বলতে পারে আমরা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘শ্যামাসুন্দরী মশার প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শ্যামাসুন্দরীকে রক্ষা করার জন্য এর পার্শ্ববর্তী জনগণকে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে। শ্যামাসুন্দরীকে আমরা দৃষ্টিনন্দন করতে চাই।’ 

কয়েক দিন আগে শ্যামাসুন্দরীর উত্সমুখ দেখতে শহরের কেল্লাবন্দ নামক স্থানে গিয়েছিলাম। ঘাঘটের শাখানদী এটি। দুঃখজনক হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী ভরাট হতে হতে নদীর তলদেশ থেকে প্রায় পাঁচ–সাত ফুট উঁচু হয়েছে। আগে ঘাঘটের পানি প্রবেশ করত শ্যামাসুন্দরীতে। আর এখন শ্যামাসুন্দরীর
ময়লা পানি নেমে যায় ঘাঘটে। নদীর পাড়ে বাড়ি শতবর্ষী শহিদার রহমানের। তিনি বলেন, কয়েক বছর থেকে পানি এত দূষিত হয়েছে যে এর পাশে দাঁড়ানো যায় না। আগে পানি ভাটিতে যেত। এখন ভাটিটাই উজান হয়েছে। পাশেই জেলা কারাগার। এই কারাগারের সব বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন এসে পড়ে শ্যামাসুন্দরীতে। 

২৬ সেপ্টেম্বরের সভায় ‘শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কার, পুনরুজ্জীবন ও সচল রাখাসংক্রান্ত কমিটি’ নামে ১২ জনের একটি কোর কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটিতে আমিও একজন সদস্য। বিভাগীয় কমিশনার ওই কমিটির প্রধান হিসেবে এরই মধ্যে একটি সভাও করেছেন। ওই সভায় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি ১৯৪০ সালের সিএস নকশা অনুযায়ী শ্যামাসুন্দরীর সীমানা চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায়ও শ্যামাসুন্দরী রক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি সভায় শ্যামাসুন্দরী সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

শ্যামাসুন্দরীর দূষিত পানিতে দূষিত হচ্ছে খোকসা, ঘাঘট এবং ঘাঘট নদ। শ্যামাসুন্দরীকে দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করা খুবই সহজ। চাইলেই জেলা প্রশাসক সেই সীমানার মধ্যে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারেন। আইনগত ও জনসমর্থন সবকিছুই শ্যামাসুন্দরী রক্ষার অনুকূলে। শ্যামাসুন্দরীর যত্ন না থাকার কারণে এ বছর বৃষ্টি হলেই শহরের অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতাও হয়েছে। আমরা আশাবাদী, এবার শ্যামাসুন্দরী নদীর দুই পারের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হবেই। অতীত সৌন্দর্যে ফিরবে শ্যামাসুন্দরী। 

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক