একবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তো

বিজ্ঞান উৎসব
বিজ্ঞান উৎসব

উৎসবের নাম ছিল ‘বিজ্ঞানে বিকাশ’। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই উৎসবে সারা দেশ থেকে স্কুলশিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে। প্রদর্শনী করেছে। বিজ্ঞান কুইজেও ওরা অংশ নেয়। ভালো ভালো পুরস্কারও ওরা পেয়েছে। মোবাইলে আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও আমাদের মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার উদ্যোগে এই বিজ্ঞান উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল কিশোর-তরুণদের আরও বেশি বিজ্ঞান–সচেতন করতে সাহায্য করা।

আলোচনায় তাদের একটা প্রশ্ন করলাম। খুব সহজ প্রশ্ন। আমি একটা চেয়ারে বসে বললাম, সোজা হয়ে বসে থাকা অবস্থায় তোমাদের কেউ কি উঠে দাঁড়াতে পারো? শর্ত হলো, ওঠার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া বা পা দুটি চেয়ারের নিচের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। আমি শত চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারলাম না। যে কেউ চেষ্টা করে দেখতে পারেন। হাত-পা বা শরীর সামনে-পিছে না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব। কেউ পারবে না। প্রশ্ন হলো, কেন?

এই কেনর মধ্যে বিজ্ঞান আছে। ব্যাপার হলো, চেয়ারে যখন সোজা হয়ে বসি, তখন মাধ্যাকর্ষণ বল আমাদের মেরুদণ্ড বরাবর নিচের দিকে টানে আর চেয়ারের পাটাতন তার বিপরীতে কাজ করে আমাদের দেহের ভর সামলায়। এই অবস্থায় উঠে দাঁড়াতে হলে ঠিক সেই মেরুদণ্ড বরাবর রেখায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে বল প্রয়োগ করতে হবে। এখানেই সমস্যা। এ জন্য সামনের দিকে একটু ঝুঁকে দেহের ভরকেন্দ্র পা বরাবর নিয়ে পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে হয়। অথবা পা দুটি একটু পেছনে নিয়ে দেহের ভরকেন্দ্র বরাবর ওপরের দিকে চাপ দিতে হয়।

আমরা অনেকেই এই ব্যাখ্যা জানি না। কিন্তু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ানোর সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ঠিকই নিই। এটা যদি বুঝি, তাহলে বুঝব, শিশুরা কীভাবে হাঁটতে শেখে। আসলে ওরা বারবার চেষ্টা করে, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য তাদের কখন, কোন দিকে ঝুঁকতে হবে, যেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ঠিক বিপরীতে দেহের ভরকেন্দ্র স্থির রাখতে পারে।

কেউ বলতে পারেন, এত কিছু জানার দরকার কী? যেভাবেই হোক চেয়ার ছেড়ে যখন দাঁড়াতে পারছি, শিশু যখন একটু বড় হয়ে দাঁড়াতে শিখছে, তাহলেই তো হলো। এটা ঠিক। কিন্তু কারণ জানার চেষ্টা করা এবং অনুসন্ধান করে কারণ জানতে পারার মধ্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশসাধন ঘটে। মস্তিষ্কে নতুন নতুন সংযোগ তৈরি হয়। এর ফলে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য আমাদের মস্তিষ্ক সক্ষমতা অর্জন করে।

আর সবচেয়ে বড় কথা, কেনর উত্তর জানার মধ্য দিয়ে আমাদের কুসংস্কার দূর হয়। সহজে কেউ ভুল বুঝিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে না। এটাই হলো বিজ্ঞান–সচেতনতার মূল ব্যাপার।

আবার দেখুন আরেকটি বাস্তব সমস্যার বিষয়। আপনি ভিড়ের মধ্যে মোবাইলে কথা বলছেন। চারদিকে হইচই। জরুরি একটা খবর জানতে হবে। কিন্তু গন্ডগোলের জন্য কিছুই শুনছেন না। আবার আপনি যা বলছেন, অপর প্রান্তের ব্যক্তিও কিছু বুঝতে পারছেন না। তাহলে কী করবেন? সাধারণত, আমরা হাতের তালু দিয়ে এক কান বন্ধ করে অপর কানে মোবাইলে কথা শোনার চেষ্টা করি। কিন্তু না, কোনো লাভ নেই। কিছু শোনা যাচ্ছে না।

এর একটা সহজ সমাধান আছে। আপনি কান চেপে না ধরে মোবাইলের নিচের দিকের কথা বলার স্লটটি আঙুল দিয়ে হালকাভাবে চেপে ধরে রাখুন। তাহলে অপর পক্ষের কথা স্পষ্ট শুনতে পারবেন। কেন? কারণ, চারপাশের গন্ডগোল তো আপনার কান দিয়ে যাচ্ছে না, যাচ্ছে মোবাইলের কথা বলার স্লট দিয়ে। তাই কান বন্ধ করে লাভ নেই।

আমরা যখন বিজ্ঞানের কথা বলি, তখন আসলে এসব কেনর উত্তর সহজভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার কথাই বলি। এটা আমার কথা নয়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করে যেতে হবে। প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা যাবে না। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন, চলতি জ্ঞানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো চিন্তা ও কল্পনা (ইমাজিনেশন) করতে পারা।

এর অর্থ হলো, প্রশ্ন করে করে প্রকৃতির সব ঘটনার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা জানতে পারলে আমরা বিজ্ঞান–সচেতনতা অর্জন করব। আমরা সহজে কুসংস্কারমুক্ত থাকতে পারব। সে জন্যই আমরা বলি, ‘সায়েন্স অব হোয়াই’ বা প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর জানতে পারার মধ্য দিয়ে আমরা সহজে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারি।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]