নাট্যসৈনিক সোলায়মান

এস এম সোলায়মান
এস এম সোলায়মান

‘ও তোমরা বুঝতে নি কেউ পারো ওগো আমার বিপত্তি/আমার মামলা চলছে তিরিশ বছর, হয় না নিষ্পত্তি।’

একটি গানের দুটি লাইন। শুনেছিলাম একজন শিল্পীর কাছ থেকে। তিনি একজন অভিনয়শিল্পী। শুধু অভিনয়শিল্পী নন, তিনি একাধারে নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, গায়ক ও সংগীতকারও বটে। বাংলাদেশে থিয়েটারের একজন উদ্যমী এবং মেধাবী কর্মী ছিলেন তিনি।

হ্যাঁ, ছিলেন। এখন আর নেই। অকালে ছেড়ে গেছেন আমাদের। সে–ও আজ প্রায় আঠারো বছর হয়ে গেল। আমার সঙ্গে পরিচয় থিয়েটার হলে, মঞ্চে—তাঁর নাটক দেখতে গিয়ে। আমি চিনলাম তাঁকে, অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, অভিভূত হলাম। তারপর দেখা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্টুডিওতে। আলাপ হলো।

তাঁর ভাষায় চট্টগ্রামের একটু টান শুনেই চমৎকৃত হলাম। কারণ, চট্টগ্রাম আমার প্রিয় জায়গা। বড় হয়েছি সেখানে। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের কিয়দংশ সেখানেই কাটিয়েছি।

‘চ্যাটগাঁইয়া পোয়া নি?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

হেসে ফেলেন মানুষটি।

‘কী করে বুঝলেন?’

বললাম আমার চট্টগ্রাম–সংশ্লিষ্টতার কথা। আলাপ হলো অনেকক্ষণ। দুই দিন রেকর্ডিং ছিল। যখনই অবসর পেয়েছি, দুজনে মেতেছি আলাপে। বেশির ভাগ আলাপ নাটক নিয়ে।

তারপর বহুদিন দেখা নেই। নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তিনিও ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু হ্যাঁ, প্রয়োজনে তাঁর কথাটিই মনে এল আমার। চাঁদ পোকা, ঘুণ পোকা নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি ধারাবাহিক নাটকের শুটিং শুরু করব। চরিত্র মনোনয়ন চলছে। হঠাৎ একটি চরিত্র নিয়ে আলাপ করতে গিয়েই ভেসে উঠল সেই শিল্পীর চেহারাটা।

তাঁর নাম এস এম সোলায়মান। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের কর্ণধার।

বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চের এক উজ্জ্বল তারকা তিনি তখন। দেখতে নরম-সরম, সদা বিনয়ী মানুষটি আসলে এক প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব। বিপ্লবী। প্রতিবাদের বীজ যেন তাঁর রক্তে, অস্থিমজ্জায় সর্বত্র।

হ্যাঁ, এমনই এক চরিত্র ছিল আমার সেই নাটকে। সুতরাং তাঁকেই আমার প্রয়োজন।

‘সোলায়মান ভাই কি করবেন?’ আমার সহকারী লিটু হেসে বলে। ‘আমার কথা বলে দেখো না, করতেও পারে।’ আমি বলেছিলাম বড় আশা নিয়ে। আশাহত হইনি। জেনেছিলাম, আমার কথা শুনেই নাকি রাজি হয়েছিলেন সোলায়মান।

চরিত্রটা ছিল সত্যিই কঠিন। একজন বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা, মুখে মুখে শেক্‌সপিয়ার আওড়ায়। গানের গলা চমৎকার, মানুষকে ভালোবাসে। একধরনের পাগলামি আছে তার ভেতর।

আর বলব কী! সোলায়মান লুফে নিলেন সেই চরিত্র। পার্ট দেখি প্রথম দিনই ঠোঁটস্থ। সব সময় বিড়বিড় করে সংলাপ আউড়ে চলছেন, যেন সর্বক্ষণ রয়েছেন নাটকের চরিত্রের ভেতর।

আমি মুগ্ধ। আনন্দিত। কারণ, এমন কমিটেড শিল্পীর বড়ই অভাব আজকাল।

প্রথম দৃশ্যের শুটিং বিপাশার সঙ্গে। গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে আসছে দুজন। পাগল বকবক করে যাচ্ছে আর অজানা কারও উদ্দেশ্যে ঢিল ছুড়ছে মাঝেমধ্যে।

ঠিক শুট করার আগে সোলায়মান আমার কাছে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, তাকে আজ ‘আপনি-আজ্ঞে’ করতে ভালো লাগছে না। প্রথম সাক্ষাতেই আমি না জিজ্ঞেস করেই ‘তুমি’-তে নেমেছিলাম।

‘একটা কথা বলব, হায়াত ভাই?’ বিনীত অনুরোধ ছিল তার।

‘নিশ্চয়ই, বলো।’

‘এখানে হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা গান গাই?’

একটু চিন্তা করে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ। গাইতে পারো। কিন্তু কী গান গাইবে?’

‘আমার একটা গান মনে এসেছে, শোনাই একটু?’

‘শোনাও।’

সে–ই গাইল। একদম চরিত্রের ভেতরে ঢুকে, সেই রকম ভাব নিয়ে গাইল, ‘ও তোমরা বুঝতে নি কেউ পারো ওগো আমার বিপত্তি, আমার মামলা চলছে তিরিশ বছর, হয় না নিষ্পত্তি’।

শুনেই আমি কুপোকাত।

‘চলবে?’ কাঁচুমাচু ভাব নিয়ে জানতে চাইল সোলায়মান।

‘চলবে মানে? খুব চলবে।’

তারপর সেই গান ঢুকে গেল আমার নাটকে। পাগলের মুখে সেই সময়কার সবচেয়ে বড় জীবননাট্য তুলে ধরা হলো। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ বছর পরও যখন কোথাও কোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি, তখন সবার মনেই ক্ষোভ, তিরিশ বছরে হয় না নিষ্পত্তি।

চরিত্রটিতে দুর্দান্ত অভিনয় করল সোলায়মান। গানটির কারণে নাটকেরও গুরুত্ব বেশ বেড়ে গিয়েছিল। ইউনিটের সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগল গানটি। আর আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে এই গানের সুরটাই সমবেত যন্ত্রসংগীতে লাগানো হয়েছিল টাইটেলে।

ব্যস, এই একটি কাজই তার সঙ্গে আমার। দেখা–সাক্ষাৎ হতো কালেভদ্রে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা স্থায়ী মুগ্ধতা রেখে গিয়েছিল সোলায়মান। তাই তার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম।

এমন একজন নিষ্ঠাবান নাট্যব্যক্তিত্বকে হারিয়ে পুরো নাট্যজগৎই মর্মাহত হয়েছিল সেদিন। বিরাট এক শূন্যতা অনুভব করেছিলাম।

অনেকগুলো দিন চলে গেছে তারপর।

আমার মতো অনেকেরই মনে নিশ্চয়ই একই রকম মুগ্ধতা চিরস্থায়ী হয়ে আছে। তাকে তো ভোলা যায় না। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জন্মদিন।  আমরা তাকে ভুলিনি। আমাদের এক সাহসী নাট্যযোদ্ধা সোলায়মান, তুমি। তোমার শুরু করা কাজ তোমার উত্তরসূরিরা হয়তো করে যাচ্ছে, কিন্তু তোমার মতো সাহসী, উদ্যমী, অক্লান্ত নাট্যসৈনিক কেন যেন আর চোখে পড়ছে না ইদানীং।

আসলে এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনই আজ কুয়াশাচ্ছন্ন। সেই কুয়াশা সরিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে, এটাই আজকের সংকল্প আমাদের। আমরা জানি, কিছু নাটকপাগল কর্মী অক্লান্ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে সেই সংকল্প পূরণে।

আর সোলায়মান, তুমি হবে তাদের আলোকবর্তিকা।

আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব