র্যাবের অভিযান, উইপোকা ও চাটার দল

পক্ষকাল ধরে চলমান র‌্যাবের অভিযান সম্পর্কে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সাধারণভাবে মানুষ একে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এর পরিণতি সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান। তাঁদের প্রশ্ন, বাংলাদেশে ক্যাসিনো ব্যবসা বেআইনি হলে কীভাবে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় এই ব্যবসা বছরের পর বছর চলতে পারল? কেন এত দিন সবাই নির্বিকার থাকলেন?

ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে এক অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ক্যাসিনো বন্ধ করতে না পারা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা নয়; পুরো সমাজের ব্যর্থতা। এ ধরনের বক্তব্য সেই সমাজের জন্য প্রযোজ্য, যে সমাজে আইনকানুন বলে কিছু থাকে না। অর্থাৎ জংলি সমাজ। সভ্য সমাজ পরিচালিত হয় আইন দ্বারা এবং কেউ আইন ভঙ্গ করলে আইন রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এখানে সমাজের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগ নেতারা এই অভিযানকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির অংশ বলে দাবি করছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, ১০ বছর পর কেন? আর দুর্নীতি কি শুধু ক্যাসিনোতে? যে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি ও অর্থনীতি ক্যাসিনো তৈরি করেছে, তার গায়ে আঁচড় না দিয়ে শুধু কয়েকটি ক্যাসিনো ক্লাব বন্ধ করে দিলে কিংবা কয়েকজন ক্লাব কর্মকর্তাকে পাকড়াও করলে তাতে আত্মতৃপ্তি পাওয়া গেলেও দুর্নীতি কমবে না। অভিযানে যুবলীগের কয়েকজন নেতা এবং একজন বিতর্কিত ঠিকাদার ধরা পড়ার পর বাতাসে আরও অনেকের নাম ভেসে আসছে। কারা কারা এসব ক্যাসিনোর লাভের টাকা পেতেন, কোন ব্যাংকে কার অ্যাকাউন্টে কত টাকা জমা হতো, তার কিছু কিছু তথ্য তদন্ত কর্মকর্তাদের বরাতে পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। আবার কিছু কিছু নাম তাঁরা গোপন রেখেছেন ‘তদন্তের স্বার্থে’। এই গোপন কথা প্রকাশিত হওয়া দরকার।

দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দুর্নীতিবাজ উইপোকারা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অর্থ লুটে নিচ্ছে। এর আগে নিউইয়র্কে তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতি না থাকলে দেশের চেহারা বদলে যেত। স্বাধীনতার পরও ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির নেতা–কর্মী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু তঁাদের নাম দিয়েছিলেন ‘চাটার দল।’ তিনি এদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী যেদিন ঢাকায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বললেন, সেদিনই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনার যে প্রাক্কলিত অর্থের বিবরণ পত্রিকায় এসেছে, তা রূপকথাকেও হার মানায়। একটি বালিশ এবং একটি বালিশ কাভারের দাম ধরা হয়েছে বাজার দামের ৩০ গুণ বেশি। একই ধরনের যন্ত্রপাতির দামের পার্থক্য ৫০০ গুণ। এর আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আসবাব কেনার নামে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জনগণের অর্থ লোপাট করেছেন, সেই তথ্য পত্রিকায় এসেছে। ফরিদপুরে হাসপাতালের পর্দা কেনার রহস্যও কারও অজানা নয়। সরকারি প্রকল্পে লাভের গুড় উইপোকারা খেয়ে নিচ্ছে। বুদ্ধিমানেরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। কিন্তু সরকারি প্রকল্প যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা অতি বুদ্ধিমান বলে প্রতিবার প্রাক্কলিত ব্যয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এসব অপকর্ম ধরা পড়ার পরও কেউ লজ্জিত হন না। রূপপুরের ঘটনায় কয়েকজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে একে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে প্রচারে নেমেছে একটি মহল।

ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগে যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলেও ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসার নিয়ন্ত্রক বলে পরিচিত ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের বিষয়ে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘আপনারা শিগগিরই দেখতে পাবেন।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, সম্রাট তাঁদের নজরদারিতে আছেন। এই ঢাকঢাক–গুড়গুড় ভাব কেন? তাঁর অপকর্ম সম্পর্কে প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় খবর বের হচ্ছে। অনেকের প্রশ্ন, ইসমাইলের কাছ থেকে যাঁরা এত দিন সুবিধা নিয়েছেন, তাঁরাই তাঁকে রক্ষা করতে সচেষ্ট কি না।

অভিযান নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে নানা রকম জল্পনা চলছে। দলের অপেক্ষাকৃত নবীন নেতারা মনে করেন, যাঁদের কারণে দলের বদনাম হয়েছে, এই অভিযানের মাধ্যমে তঁাদের বের করে দেওয়া যাবে। আবার কেউ কেই এই শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন, যেখানে ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় রাজধানী থেকে উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত দুর্নীতি মহামারি রূপ নিয়েছে, সেখানে দুর্নীতিবাজদের ধরলে দল টিকিয়ে রাখা যাবে কি না। কেননা এই অভিযানের সময় ক্ষতিগ্রস্তরাও বসে থাকবে না। তারা পাল্টা আঘাত হানতে চাইবে এবং তা মোকাবিলার সামর্থ্য সরকারের আছে কি না। এক যুবলীগ থেকে যখন ডজন ডজন বিলিয়নিয়ার বের হচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে কত বিলিয়নিয়ার বের হবে, অনুমান করা কঠিন নয়। অভিযান নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কাদা–ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেছে। সিলেট অঞ্চলের একজন সাংসদকে ‘চাঁদাবাজির গডফাদার’ বলে অভিহিত করছেন স্থানীয় নেতারা। চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক সাংসদের বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগ এনেছেন আওয়ামী লীগেরই একজন জ্যেষ্ঠ নেতা।

একসময় এক দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অন্য দলে গ্রহণ করা হতো ফুলের মালা দিয়ে। যোগদানকারী নেতারাও তুমুল করতালির মধ্যে দলের নীতি-আদর্শ সমুন্নত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার রাখতেন। পুরোনো দলের কাজকর্মের নিন্দা করতেন। পুরোনো দলও চুপচাপ বসে থাকত না। তাঁকে গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করে দিত। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে যাঁরা আওয়ামী শিবিরে (আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো) এসেছেন, তাঁরা কেউ ফুলের মালা নিয়ে আসেননি। টাকার বস্তা নিয়ে এসেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। তাঁরা তাঁদের পুরোনো ব্যবসাও ছাড়েননি। আগে যাঁরা ক্যাসিনো ব্যবসা করতেন, নতুন দলে এসেও তাঁরা সেই ব্যবসা করছেন। আগে বিএনপির নামে যাঁরা ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতেন, এখন আওয়ামী লীগের নামে বাগিয়ে নিচ্ছেন। আগে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের প্রশ্রয় পেতেন, এখন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের প্রশ্রয় পাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁরা দল বদলালেও নিজেদের নীতি বদলাননি। এটাই হলো দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বৈশিষ্ট্য।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকার স্বেচ্ছায় ও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই অভিযান চালনা করেনি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানো ছাড়া তার কোনো বিকল্প ছিল না। গত বৃহস্পতিবার কথা হয় গুলশান-বনানী এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে। অভিযানে তাঁরা খুশি। সরকারি দলের নেতাদের নাম ভাঙিয়ে যাঁরা এত দিন চাঁদাবাজি করতেন, গত ১৫ দিনে তাঁদের টিকিটি দেখা যায়নি। তাঁরা আরও বলেন, সৎ ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ। বিলম্বে হলেও যদি সরকারের চৈতন্যোদয় ঘটে, তাকে ব্যবসায়ীরা সাধুবাদ জানাবেন। এর আগে আরেকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে আলাপ হয় একজন তরুণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যিনি উত্তরাধিকারসূত্রে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর অভিযোগ, ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রায় সব খাতই এখন কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। প্রভাবশালীদের ‘খুশি’ না করে কোনো ব্যবসা করা যাচ্ছে না। সরকারের এই অভিযান যদি ওই কথিত প্রভাবশালীদের কিছুটা খামোশ করতে পারে, সৎ ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কি শুধু ক্যাসিনো বন্ধের মধ্যে সীমিত থাকবে, নাকি যে দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি ও রাজনীতি অবৈধ ক্যাসিনো সংস্কৃতি তৈরি করে, তার মূলে আঘাত করবে? ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কারণে কিছু লোক বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিলেও হাজার হাজার মানুষ পথে বসেছে। আওয়ামী লীগ সরকারেরই একজন সাবেক মন্ত্রী বলেছেন, গত ১০ বছরে ৯ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল করতে হলে যারা এসব অর্থ লোপাট ও পাচার করেছে, তাদেরও পাকড়াও করতে হবে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে হবে। অন্যথায় এই অভিযান সাময়িক চমক সৃষ্টি করতে পারে, দুর্নীতিবাজদের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগবে না।

অভিযান নিয়ে কৌতূহল আছে বিদেশিদেরও। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকেরা অভিযানের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। ঘরোয়া আলাপে ইউরোপীয় দেশের একজন রাষ্ট্রদূত জানতে চাইলেন, ‘এরপর কী?’ অর্থাৎ অভিযান ক্যাসিনোর মধ্যেই সীমিত থাকবে, নাকি দুর্নীতির অন্যান্য উৎসে হাত দেবে?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]