খুব প্রয়োজন আপনাকে, প্রিয় শিক্ষক

বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় আইপিডিসি আর প্রথম আলো যৌথভাবে দেশের ১২ জন শিক্ষককে ‘প্রিয় শিক্ষক’ সম্মাননা দিল। https://www.prothomalo.com/priyoshikkhok বাংলাদেশে জন্ম নিল এক নতুন ধারা। যাঁরা সম্মানিত হলেন, তাঁরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রিয় শিক্ষককে মনোনয়ন দেন তাঁদেরই প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাঁরা; কিন্তু তাঁদের বিবেচনায় এই প্রতিষ্ঠার পথ বেঁধে দিয়েছিলেন প্রথম জীবনের প্রিয় শিক্ষক। তাঁদের বিবেচনায় শিক্ষক হলেন শিশুর জীবনের মহত্তম নায়ক। প্রত্যেকের মনোনয়নে উঠে এসেছে বিচিত্র সব অজানা গল্প। আয়োজকেরা তা যাচাই করেছেন এবং সেলুলয়েডে পুনর্নির্মাণ করেছেন সেসব কীর্তিগাথা।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বাংলাদেশের সব শিক্ষকের সঙ্গে বিশেষভাবে অভিনন্দিত করছি প্রিয় শিক্ষকদের। শুভ্রতার প্রতীক ফরিদপুরের জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, আলোর মশাল হাতে যশোরের তারাপদ দাস, হাজারো শিক্ষার্থীর মা ময়মনসিংহের নাছিমা আক্তার, সব ভালোর আগে রাঙামাটির নিরুপা দেওয়ান, স্বপ্নকে সত্য করেছেন ময়মনসিংহের মফিজ উদ্দীন। এ তালিকায় আছেন মানুষ গড়ার কারিগর সাতক্ষীরার মো. আবদুস সালাম, বাধাজয়ী টাঙ্গাইলের আবুল হাশিম মিয়া, জীবন দক্ষতার শিক্ষক বাগেরহাটের মো. আসাদুল কবির। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাঁর সুনাম বিদেশেও, গাইবান্ধার শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বপ্নপুরুষ মো. নূরুল আলম। সে তালিকায় দেখি ভালোর পথে অবিচল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. শাহজাহান কবীর, স্বপ্নের পথে হেঁটে চলা চট্টগ্রামের লুৎফুন্নিছা খানম আর জীবনের অঙ্ক শেখানো শিক্ষক চট্টগ্রামের সফিক উল্ল্যাকে।

তাঁদের নিয়েই গত সন্ধ্যায় রাজধানীতে বসেছিল তারার মেলা। সে মেলায় হাজির ছিলেন দেশের বরেণ্য শিক্ষকদের অনেকেই। তাঁদের অনেকেই এসেছিলেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে, রাজধানীর নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

শিক্ষকতা একটি ব্রত, পেশা নয়। হৃদয়ের গভীরে জ্বালিয়ে রাখা আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা বানান প্রিয় ছাত্রদের। কিন্তু বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে এক শ্রেণির শিক্ষক সেই পবিত্র ধর্ম থেকে বিচ্যুত। প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠানে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শিক্ষকতার এই অধঃপাতে তিনি লজ্জিত। কিন্তু সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন এমন উজ্জ্বল এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ, সৃষ্টিশীল শিক্ষককের সমাবেশে এসে। স্পষ্ট বললেন, এই সম্মাননা এ দেশের সব শিক্ষককে সম্মানিত করল, আশান্বিত করল।

কোন ধরনের শিক্ষক পেলেন সম্মাননা? না, রাজধানীর নামীদামি স্কুলের শিক্ষক তাঁরা নন। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন তাঁরা। ব্রত বলেই শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, বেচাকেনার সামগ্রী নয় তাঁদের কাছে। কোনো প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশীও ছিলেন না কখনো। প্রচলিত বেতনেই, প্রচলিত সুবিধাটুকুতেই সন্তুষ্ট থেকে মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করে গেছেন, সুখের ঘর তৈরির স্বপ্ন ত্যাগ করেছেন অবলীলায়। বাগেরহাটের যোগেশ বাবুর কথা আমরা অনেকেই জানি। স্কুল ছিল তাঁর সংসার। ছাত্ররা তাঁর সন্তানের অধিক। যোগেশ মণ্ডল গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। আয়োজকেরা মরণোত্তর সম্মাননা না দেওয়ার নীতিতে ছিলেন। দিলে হয়তো যোগেশ বাবু তালিকার শীর্ষে উঠে আসতেন।

প্রিয় শিক্ষকের আজীবন সম্মাননা পেলেন ফরিদপুরের জগদীশ চন্দ্র, তারাপদ স্যার বলেই যিনি পরিচিত। তিনি এক কিংবদন্তি। ৯২ বছর বয়সেও সমান সক্রিয়। তাঁর হাসিমুখ যে কাউকে আত্মবিশ্বাসী করবেই। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের বেদিমূলে পরিবারের ২৮ জন জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের দুর্লভ আনন্দে ভুলে গেছেন স্বজন হারানোর বেদনা।

একটা প্রশ্ন উঠেছিল, প্রিয় শিক্ষক নির্বাচনে ভালো শিক্ষকের মাপকাঠি কী হবে? সে প্রশ্নের জবাব মেলে এ সম্মাননায় নির্বাচিত তালিকায় চোখ বুলালে। শুধু ক্লাসে পড়া আদায় করাই ভালো শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য নয়। তিনিই উত্তম শিক্ষক, যিনি পড়ুয়ার মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা খুঁজে বের করতে পারেন; পড়ুয়ার প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেন এবং সেভাবে তাকে গড়ে তোলেন। শুধু পাঠ্যবইয়ের ঘেরাটোপে বন্দী থাকা নয়। একজন শিক্ষার্থী ক্রীড়া নৈপুণ্যে, চিত্রাঙ্কনে, সংগীতে, সমাজ উন্নয়নে তথা জীবনের বিবিধ পরিক্রমায় অংশ নিয়ে উজ্জ্বল করতে পারে দেশের মুখ। একজন আদর্শ শিক্ষক স্বপ্ন দেখেন তাঁর ছাত্র বা ছাত্রী তাঁকে শুধু অতিক্রমই করবে না, সমাজের, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে, এমন সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে কোন শিশুর মধ্যে?

শিক্ষা দার্শনিক ব্লুমের বিশ্বাস, শিশুর কৈশোরেই সে সম্ভাবনার বীজ উপ্ত হয়। আর তা বিকশিত হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষকের হাতে। ব্লুম কেন রবিনসনও শিশুদের মধ্যে খুঁজে পান অসীম সম্ভাবনা। সেই প্রাচীনকালেই মহান গুরু সক্রেটিস শিশুর অসীম সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তাই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করেছেন নবীনদের মনে নানা প্রশ্ন জাগিয়ে জাগিয়ে। রুশোও সেই কথাই বলেছেন। সতর্ক করেছেন, শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর ভয়ংকর পরিণাম সম্পর্কে। কিন্তু বাণিজ্যে লিপ্ত এক শ্রেণির তথাকথিত শিক্ষক নোট, গাইড, কোচিং সেন্টারের জাদুটোনায় ধ্বংস করে দিচ্ছেন লাখ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ। আর সে ফাঁদে পা দিচ্ছেন অভিভাবকেরাও। এভাবে লুট হয়ে যাচ্ছে শিশুর শৈশব, শিশুর স্বপ্ন, মেধা সবই।

কোমলে-কঠোরে, শাসনে-আদরে একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের গড়ে তোলেন গভীর মমতায়, আদর-স্নেহে। পড়ুয়ার চোখে স্বপ্ন বুনে দেওয়াই ভালো শিক্ষকের আসল কাজ। সদাচারের মাধ্যমে শিক্ষার্থী সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবে। শিক্ষকের কাজ মানুষ গড়া। মানব ধর্মে দীক্ষা দেওয়া। মানবিকতা অর্জনই শিক্ষার শেষ মঞ্জিল।

কিন্তু অযোগ্য শিক্ষক কারা? যাঁরা বিদ্যাবাণিজ্যের কারবারি। পথহারা, বিদ্যা বিক্রি করে ধনী হওয়ার ইঁদুর দৌড়ের নেশায় পাওয়া কেউ যেন ভুল করেও প্রিয় শিক্ষকের মর্যাদা না পান, সেদিকে কঠোর দৃষ্টি ছিল আয়োজক দুই প্রতিষ্ঠানের। ক্লাসেই শেখা প্রত্যেক পড়ুয়ার অধিকার। কোচিং-এর ফাঁদে যাঁরা শিশুদের আটকাতে চান, তাঁরা ভালো শিক্ষক তো ননই, তাঁরা দুর্বৃত্ত; দেশ ও জাতির দুশমন। বার্তাটি আয়োজকেরা দিতে পেরেছেন কঠোরভাবেই।

দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এখন নৈরাজ্য। ভাঙনের সুর সর্বত্র। সততা নির্বাসিত। নিষ্ঠা কিংবা শিষ্টাচার দুর্লভ। শিক্ষার্থীরা তাই বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট। সমাজ-রাষ্ট্রে অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বারুদ নিয়ে ব্রতী যে শিক্ষক, তিনিই পারেন আলোর পথ দেখাতে। আমরা সত্যদ্রষ্টা শিক্ষকের খোঁজে প্রিয় শিক্ষক সম্মাননার আয়োজনে নতুন স্বপ্নের জাল বুনব।

আমিরুল আলম খান: লেখক ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]