আমাদের রাজা-বাদশাহ-সম্রাটেরা

রাজা-বাদশাহ-সম্রাটেরা কেবল জুয়া, মদ আর মাদকের আড্ডাখানাতেই বসে নেই।
রাজা-বাদশাহ-সম্রাটেরা কেবল জুয়া, মদ আর মাদকের আড্ডাখানাতেই বসে নেই।

অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়া একটি দেশ। তবে এগিয়ে চলার গতি বলে দিচ্ছে এই অবস্থার পরিবর্তন শিগগির না হলেও সেই লক্ষ্য অর্জন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়। ফলে অগ্রসর দেশের কাতারে যোগ দিতে হলে অগ্রসর চিন্তাভাবনার জন্যও সমাজে জায়গা করে দেওয়া দরকার। রাজনৈতিক ব্যবস্থার কিছু দৃষ্টিকটু বৈশিষ্ট্য থেকে দেশকে বের করে আনা দরকার। অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হয়।

বিশ্বের পিছিয়ে পড়া অনুন্নত একটি দেশ হলেও বাংলাদেশে যে দুর্লভ একটি জিনিসের অভাব নেই তা হলো রাজা-বাদশাহ-সম্রাটদের উপস্থিতি ও প্রতিপত্তি। মুকুট পরা রাজা-বাদশাহ না হলেও প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বিত্তের মাপকাঠিতে এঁরা সত্যিকারের রাজা-বাদশাহদের চেয়ে কম নন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সময়োচিত পদক্ষেপ। তবে এ পদক্ষেপ লোকদেখানো কিংবা সাময়িক হলে রাজা-বাদশাহরা আবারও ফিরে আসবেন এবং অনেক বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠবেন। ফলে এঁদের উত্থানের পথ বন্ধ না করা গেলে সাময়িক পদক্ষেপে যেটুকু লাভের দেখা পাওয়া যাচ্ছে, তার সবটাই যে কেবল হারিয়ে যাবে শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে সমাজকে তা ঠেলে দেবে আরও অনেকটা পেছনের দিকে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের স্বপ্ন ছিল এমন এক সমাজ গড়ে তোলার, যে সমাজে থাকবে না বড় দাগের কোনো বিভাজন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আমরা বাস্তবে পরিণত করতে পারিনি স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে পথচলায় বড় ধরনের হোঁচট খাওয়ার কারণে। ১৯৭৫-এর মর্মান্তিকতা এবং সেই সূত্রে চলে আসা এক বর্বর সমাজ আমাদের ধাবিত করেছিল অধঃপতনের দিকে। বর্বর সমাজ আমি এ কারণে বলছি যে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই, যা কিনা আপনাকে দেখিয়ে দিতে সক্ষম খুনি-লুটেরাদের রক্ষা করায় সাংবিধানিক অধিকারের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, সে রকম কোনো দৃষ্টান্ত।

ফলে ওই যে পেছনের দরজার রাজা-বাদশাহ-সম্রাট, এঁরা কিন্তু সে রকম এক কলিকালের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন, যে কলিযুগ এঁদের বলে দেয় ফায়দা লুটে নেওয়ার সময় এখন আগত। আমাদের সম্রাটদের উত্থানের শুরুটা কিন্তু সেই পথে, যদিও পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনঃপ্রবর্তিত হলেও থেকে যাওয়া উচ্ছিষ্টের মতো দীর্ঘ স্বৈরশাসনের ফলে সমাজে তৈরি হয়ে যাওয়া নতুন নানা রকম ফাঁকফোকর রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বাদশাহ-সম্রাটদের সেবা লাভ আবশ্যকীয় করে তোলে এবং সেই পথে নতুন প্রজন্মের রাজা-বাদশাহরা এঁদের আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সেই সময়ে আমরা যা দেখেছি তা হলো, কেবল রাজা-বাদশাহদের উত্থানই নয়, রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি স্তরে এঁদের ক্রমেই সম্প্রসারমাণ আধিপত্য। এর কারণ অবশ্যই আনুগত্যের বিনিময়ে সুবিধা ভোগের পথ করে দেওয়ার রাজনীতির মধ্যে নিহিত। এঁদের চোখ একমাত্র যেদিক পানে খোলা থাকে তা হলো, ক্ষমতার আরও বেশি চাটুকারিতা কীভাবে করা যায়, সেই পথের দিশা খুঁজে পাওয়া। চাটুকারিতার মধ্য দিয়ে নিজের সাম্রাজ্য যে গড়ে নেওয়া সম্ভব, সেটা এঁদের ভালোভাবে জানা আছে। আর তাই ক্ষমতার হাতবদল হলেও এই রাজা-বাদশাহদের দেখা যায় দ্রুত উল্টো পথে গাড়ি হাঁকিয়ে চলমান হাওয়ার সঙ্গে মিশে যেতে।

রাজনীতি কেন এতটা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে এবং কেনই–বা রাজনীতির দোহাই দিয়ে টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি করতে হবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনে হয় বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করা দরকার। একজন ছাত্র কেন ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ হাতিয়ে নিতে টেন্ডার বাক্স ছিনতাই করার পরও আনুগত্যের খাতিরে পার পেয়ে যাবে, রাজনীতিবিদদেরই সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে হবে। বয়স ৭০ বছর পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে কেন যুবকদের সংগঠনের হাল ধরে বসে থাকতে হবে, সেই প্রশ্নের উত্তরও এঁদেরই খুঁজে দেখা দরকার।

পাশাপাশি অন্য যে একটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া অতীব প্রয়োজন তা হলো, রাজা-বাদশাহ-সম্রাটেরা কিন্তু কেবল জুয়া, মদ আর মাদকের আড্ডাখানাতেই বসে নেই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও এঁরা ধস নামাতে শুরু করেছেন। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ-পদোন্নতি—এ রকম সর্বক্ষেত্রেই স্থানীয় রাজা-বাদশাহ-সম্রাটদের দাপট সহজেই চোখে পড়ে। ফলে সময় হয়েছে সেই রাজা-বাদশাহদের দিকেও ন্যায়দণ্ডের হাত সম্প্রসারিত করে নেওয়া। কেননা, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ন্যায়নীতি বলতে কিছু নেই, সম্রাটদের উত্থান তো সেখান থেকেই। ফলে সেখানেও পালের গোদাদের দিকে হাত বাড়ানোর সময় মনে হয় এখন উপস্থিত। সে রকম কিছু করতে পারলেই আমরা আশা করতে পারি মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্যে যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন আমরা একদিন দেখেছিলাম, সে রকম বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথে বিলম্বে আর ধীরে হলেও যাত্রা শুরু করতে পারা। এটা এক দিনে সম্ভব নয় এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জায়গা করে নেওয়া সম্রাট-রাজা-বাদশাহদের চিহ্নিত করে এঁদের মূলোৎপাটন করার কাজ মোটেও সহজ নয়। তবে কঠিন মনে করে যাত্রা অসমাপ্ত রেখে অর্ধপথে হাল ছেড়ে দেওয়া হলে সমাজ কিন্তু আবারও ফিরে যাবে সেই একই কানাগলিতে।

সরকারকে ধন্যবাদ, বিলম্বে হলেও শুভবুদ্ধির মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত একটি কাজ শুরু করার জন্য। আর লক্ষ্যের সফল সমাপ্তির পথে যাত্রায় এই শুভবুদ্ধির লোকজনই যে পাশে থাকবেন, সেই প্রত্যাশা সরকার অবশ্যই করতে পারে।

মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক