আবরারের মায়ের প্রশ্নের জবাব দিন

আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারের দাবিতে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিল। বুয়েট ক্যাম্পাস, ঢাকা, ৮ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম
আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারের দাবিতে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিল। বুয়েট ক্যাম্পাস, ঢাকা, ৮ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম

ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার দৈহিক নির্যাতনে নিহত আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন প্রশ্ন করেছেন কোন অপরাধে তাঁর ছেলেকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো? এই প্রশ্নের জবাব দেয়নি কেউ। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আবরার দেশের সেরা যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও কেউ কোনো জবাব দেননি। প্রশ্নটা কিন্তু আবরারের মায়ের একার নয়। এখন এই প্রশ্ন সবার—দেশের সব মায়ের, সব পিতার, সব ভাইয়ের, সব বোনের।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন আরও অনেক। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সোমবার ৭ অক্টোবর তাঁরা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছেন, ‘আবরার ফাহাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর’ ঘটনায় তাঁরা থানায় জিডি করেছেন। হত্যার ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হিসেবে বর্ণনা করার কারণটা কি কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা করবে? আমাদের কি এ কথা বিশ্বাস করতে হবে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড আর অপ্রত্যাশিত বা আচমকা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ফারাক বোঝেন না? নাকি ছাত্রলীগের এসব দুর্বৃত্তকে রক্ষার অঘোষিত দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই তাঁরা ঠান্ডা মাথার খুনিদের ঘৃণ্যতম অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা করছেন?

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোই বা আমরা কীভাবে উপেক্ষা করি? এ রকম একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর উপাচার্য ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াননি (সমকাল, ৮ অক্টোবর ২০১৯)। তিনি অসুস্থ হলেও তো তাঁর পক্ষে সহ-উপাচার্য বা রেজিস্ট্রারের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সেখানে পাঠিয়ে দুঃখ প্রকাশ এবং সমবেদনা জানানো তাঁর দায়িত্ব। প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা ধরে আবরারের ওপর যখন নির্যাতন চালানো হয়, তখন তো আর্তচিৎকার হাউস টিউটর এবং প্রভোস্টের কানে পৌঁছানোর কথা। নিশ্চয়ই আবরারকে আরও আগেই সেখান থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব ছিল না। হল প্রশাসন কীভাবে তাদের দায়িত্বহীনতার লজ্জা থেকে মুক্তি পাবে? অভিযোগ উঠেছে ছাত্রাবাসগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাদের রুমে রুমে টর্চার সেল চলে। এবং, সে কারণেই নেতাদের রুম থেকে চিৎকার এলেও অন্য ছাত্ররা সেখানে এগিয়ে যেতে সাহস পায় না। আবরারের ক্ষেত্রেও সে রকমটি ঘটার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া পূজার ছুটির জন্যও ছাত্রদের একটা বড় অংশ বাড়িতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এসব টর্চার সেলের অস্তিত্বের কথা প্রকাশ হতে আবরারকে প্রাণ দিতে হবে কেন? হাউস টিউটর আর প্রভোস্টদের কাজ কী? তাঁদের দায়িত্ব কি শুধু র‌্যাগিংয়ের শিকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু টেলিফোন নম্বর নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে রাখা?

হত্যাকাণ্ডের যেসব বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, আবরার তার ফেসবুকে কী লিখেছে, কোন মত বা আদর্শকে সমর্থন করত—এসব কিছু যাচাই-বাছাইয়ের মুখে পড়তে হয়েছে। মত বা আদর্শ যাচাইয়ের কাজটি কারা করেছে? কিসের ভিত্তিতে? বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তা ও মতাদর্শের ওপর নজরদারি এবং যে বা যারা ভিন্নমতের অনুসারী, তাদের শায়েস্তা করার দায়িত্বভার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একদলীয় ঘাঁটি বানানোর যে প্রক্রিয়া বছরের পর বছর চলে আসছে, তা কি জাতীয় রাজনীতির চলমান ধারা থেকে খুব একটা আলাদা? আবরার ফেসবুকে ভারতকে একতরফাভাবে ফেনী নদীর পানি দেওয়ার সমালোচনা করেছে, শহীদ মিনারে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভের ভিডিও দিয়ে তার প্রশংসা করেছে। এগুলো সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান নীতির পরিপন্থী। স্পষ্টতই সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন সরকারের পক্ষে এখানে লাঠিয়ালের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল এখানে কীভাবে তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করবে?

বুয়েটের এ ঘটনা যে একটি বিচ্ছিন্ন অঘটন তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্নমত দমনে ছাত্রলীগ যে অনেক দিন ধরেই দাপট ফলিয়ে আসছে, তা কোনো নতুন খবর নয়। এমনকি দলবাজ শিক্ষকদের যাঁরা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে আসীন হয়েছেন, তাঁরাও যে অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে একই ভূমিকা নিয়েছেন তারও ভূরি ভূরি নজির দেওয়া যায়। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো এবং সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ফেসবুকে মতপ্রকাশের জন্য ছাত্রলীগের চাপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের জেলে যাওয়া, তাঁকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি মঞ্জুরে কর্তৃপক্ষের টালবাহানা কিংবা সরকারপ্রধানের সমালোচনার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সাজার ঘটনাগুলো এখানে স্মরণ করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে একাধিক শিক্ষকের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাগুলোও ভুলে যাওয়ার নয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চা, বিতর্ক ও বহুমতের তীর্থকেন্দ্র হওয়ার কথা যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর, সেগুলোকে একদলীয় করার আয়োজন বহুদিন ধরেই চলছে। তারই চরম এবং নিষ্ঠুর পরিণতি আবরারের হত্যাকাণ্ড।

সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভিন্নমতের জন্য একজন মানুষকে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই। তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, বিএনপি বলছে ‘ভারত সফরে দেশ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তাই বলে কি বিএনপিকে মেরে ফেলব? বিএনপির যে নেতারা এগুলো বলছেন তাঁদের কি মেরে ফেলব? ‘(সমকাল, ৮ অক্টোবর ২০১৯)

এই কথাগুলো যে বলা প্রয়োজন তা অনুভব করা এবং বলার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। এ সময়ে অবশ্যই এ ধরনের আশ্বাসের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এই আশ্বাসটুকুই কি যথেষ্ট?

ভিন্নমত দমনে তাঁর সরকার এবং দল কী করতে বাকি রেখেছে তা কি তিনি বলতে পারেন? ভিন্নমত দমনে গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ার যেসব অভিযোগ কয়েক বছর ধরে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, সেগুলো আমরা কীভাবে ভুলে যাব? প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিবর্তনমূলক আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরির কথাও কি মন্ত্রী অস্বীকার করবেন? ভিন্নমত দমনে এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার ভুক্তভোগীরাই জানেন যে এর জ্বালা কত তীব্র এবং সর্বনাশা। নাগরিকদের মতপ্রকাশের সবচেয়ে বড় উপলক্ষ যেটি, সেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকারের গুরুত্বই বা কেন উপেক্ষিত হবে? নির্বাচনী ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন করার লক্ষ্যই তো ছিল গণতন্ত্রের নামে কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।

আবরারের খুনিদের বিচার করা হবে বলেও সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আবরারের খুনের যথাযথ বিচার আমাদের সবার দাবি। তবে একই সঙ্গে আবরারের মায়ের প্রশ্নের জবাবটাও প্রয়োজন। ভিন্নমতের জন্য আবরারকে জীবন দিতে হয়েছে এই স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট নয়, এই পরিস্থিতি তৈরির দায় নির্ধারণ জরুরি। ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ এবং তা দমনে বলপ্রয়োগের নীতি পরিত্যাগের অঙ্গীকারও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় রাজনীতির সংকটের কেন্দ্রে থাকা এসব সমস্যার সমাধানও আমাদের খুঁজতে হবে।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক