আবরারের স্ট্যাটাস ও ফেনী নদীর পানি

ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়ার পর ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ। ফেসবুক পোস্টে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের সর্বশেষ চুক্তিগুলোর সমালোচনা করেছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ফেনী নদী প্রসঙ্গ।

আবরারের আপত্তি বুঝতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ফেনী চুক্তি না, অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিত দেখতে হবে। আবরার তাঁর পোস্টে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং এরপর অকালে হারিয়েছেন তাঁর অসীম সম্ভাবনাময় জীবন।

২.
ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি দেওয়া হবে সেকেন্ডে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক, অর্থাৎ প্রায় ৫০ লিটার। প্রতিদিনের হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ লিটার পানি। শুকনা মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল) ফেনী নদীতে যে পানি পাওয়া যায়, তা বিবেচনায় নিলে এই পরিমাণ পানিকে অনুল্লেখ্য বিবেচনা করার সুযোগ নেই।

বর্তমানে অনেক বাড়িয়ে বলা হলেও ২০০৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ-নদী গ্রন্থের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠার তথ্য অনুসারে, শুকনা মৌসুমে এই পানির পরিমাণ সর্বনিম্ন মাত্র ৪৭ কিউসেক। মুহুরী সেচ প্রকল্প বাদেও অন্যান্য কারণে ফেনী নদীর পানি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। এই পানির একটা অংশ তবু দেওয়া হয়েছে ত্রিপুরার মাত্র হাজার আটেক অধিবাসীর একটি শহরের খাওয়ার পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটা দেওয়া হচ্ছে মানবিক কারণে।

ফেনী নদীর সামান্য অংশ সীমান্তে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ছড়ার পানি মিলে এটি বেগবান হয়েছে সীমান্ত পার হওয়ার পর। বাংলাদেশ নিম্ন অববাহিকার দেশ বলে এই পানি ভারতকে দেওয়ার কোনো রকম আইনগত বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের নেই। মানবিক কারণ ছাড়া এ পানি দেওয়ার তাই কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবিকতা কি শুধু একতরফা একটি বিষয়? মানবিকতা দূরের কথা, এমনকি আইনগত অধিকারগুলো কি আমরা ভারত থেকে পেয়েছি অভিন্ন নদীর পানির ক্ষেত্রে? কিংবা অন্য অনেক ক্ষেত্রে?

আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিতে ‘ভাইটাল হিউম্যান নিডস’ বলে একটি কথা আছে। খাওয়ার পানি ও জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় শস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত পানিকে ভাইটাল হিউম্যান নিডস বলা হয়। এসব কারণে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদী থেকে পানি পাওয়া খুব জরুরি বাংলাদেশের জন্য। সেই আলোকে ১৯৮৬ সালে গঙ্গা বাদে আরও আটটি বড় অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি করা হবে—বলেছিল দুই দেশের জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্ট। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিতে সব অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে চুক্তি করার কথা বলা আছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই ভাগাভাগির চুক্তি আর হয়নি।

ভারতের যুক্তি, এসব নদীর পানিপ্রবাহের পরিমাণ নিয়ে দুই দেশের তথ্যে গরমিল আছে। গত মাসেও ভারত বলেছে, এ বিষয়ে আগে স্বীকৃত তথ্য মিলুক, ভাগাভাগি চূড়ান্ত হবে তারপর। ভারতের পানিসচিব বাংলাদেশে এসে বললেন, আটটি নদীর (মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, ফেনী, তিস্তা ও দুধকুমার) পানি ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ ভাগাভাগির বিষয়ে তাঁরা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অগ্রগতি আশা করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সমঝোতা হলো শুধু ফেনীর বিষয়ে। এমনকি ২০১১ সাল থেকে ঝুলে থাকা তিস্তার বিষয়ে কোনো নতুন কথা শোনা গেল না।

এসব চুক্তি কবে হবে, তা নিয়ে আবরারের মতো বাংলাদেশের যেকোনো মানুষের হতাশা স্বাভাবিক। কারণ, অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ভারতের অনীহার তথ্য আমরা বহু সময় পেয়েছি। দুই দেশের সচিব পর্যায়ের মিটিংটি গত মাসে হয়েছে প্রায় আট বছর পর। যৌথ নদী কমিশনে মন্ত্রী পর্যায়ে মিটিং শেষবার হয়েছে ২০১০ সালে। এরপর বহুবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিটিং করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প নিয়ে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে ভারত, তাতে বাংলাদেশের পানির চাহিদা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা নিয়ে এবারও কিছু বলেনি তারা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিতে রাজি হওয়ার বিষয়টি বহু মানুষকে ক্ষুব্ধ করতেই পারে।

৩.
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি। প্রশ্ন উঠেছে সেসব নিয়েও। বাংলাদেশ ভারতে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হয়েছে। বিদ্যমান সড়কব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব, পরিবহনঝুঁকি আর বাংলাদেশের জ্বালানিনিরাপত্তা স্পষ্ট করা হয়নি দুই দেশের প্রকাশিত তথ্যে।

নতুন একটি চুক্তি অনুসারে ভারত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে নজরদারি করার জন্য রাডার সিস্টেম বসাবে। এমন রাডার সিস্টেম ভারত বসাতে পেরেছে মালদ্বীপ, মরিশাস আর সেশেলসের মতো ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোয়। সেই কাতারে আমরা নামলাম কিসের বিনিময়ে? এই সার্ভিল্যান্সের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কার হাতে?

প্রশ্ন আছে অন্য বিষয়গুলো নিয়েও। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আর মোংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, কিন্তু ভারতের কোনো বন্দর বাংলাদেশের ব্যবহারের কথা নেই কেন? বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটান আর নেপালের সরাসরি সংযোগের জন্য ভারতের স্থল করিডর ব্যবহার প্রসঙ্গে কোনো অগ্রগতি নেই কেন এবারও? বহু আশ্বাসের পরও সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষ হত্যা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই কেন কোথাও?

ভারত থেকে আমরা পেয়েছি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিনিময়ের কিছু সহায়তা, যার গুরুত্ব অনুল্লেখ্য। যেমন রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রাবাস নির্মাণ বা খুলনায় একটি পেশাজীবী প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা। ভারত বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। এই ঋণের শর্ত নিয়েও প্রশ্ন আছে দেশে।

৪.
ভারত সফরে যাওয়ার আগে দুটো বিষয় নিয়ে উদ্বেগের কথা বলেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এসবের কোনো সদুত্তরও আসেনি দুই দেশের চুক্তি, সমঝোতা বা যৌথ বিবৃতিতে। গণহত্যা করে মিয়ানমার থেকে অমানবিকভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে। এমন একটা ইস্যুতে সর্বশেষ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থেকেছে ভারত। এ বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ ও প্রত্যাশা কতটা গুরুত্বহীন, তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ না করে সেখানে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের সহায়তার অঙ্গীকার করেছে ভারত। কিন্তু আমরা তো খাবার, কম্বল বা তাঁবুর মতো পুনর্বাসন সহায়তা চাইনি ভারতের কাছে, আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভারতের সমর্থন ও সহায়তা। দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে তার প্রতিফলন নেই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উত্কণ্ঠা জানিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) নিয়ে। আসামের পর এমন এনআরসি করার তোড়জোড় হচ্ছে ভারতের আরও কিছু রাজ্যে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা প্রকাশ্যেই বলছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়া লোকজনকে ফেরত পাঠানো হবে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের জবাবে মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে এ নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তার কিছু নেই, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সত্যি চিন্তার কিছু না থাকলে তার উল্লেখ বা আশ্বাস যৌথ বিবৃতিতে নেই কেন?

‘চিন্তার কিছু নেই’ বা ‘বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না’—এসব আশ্বাস রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্টও নয়। এর আগে বাংলাদেশের জন্য চরম ক্ষতিকর ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর আগে এক দশক ধরে ভারত তা-ই বলে এসেছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে পরিত্যক্ত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ক্ষেত্রে একই কথা বলেছিল ভারত। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া আশ্চর্যজনকভাবে একই কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রীও।

এনআরসি নিয়ে একই ধরনের আভাস পাই ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার কাছে দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার ৬ অক্টোবরের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছেন, ভারতে সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর নিজেদের যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত আছে বাংলাদেশ। এই বক্তব্য কী বার্তা দেবে ভারতকে?

৫.
দুই দেশের সম্পর্ক শুধু নীতিনির্ধারকদের সম্পর্ক নয়; এটি দুই দেশের জনগণের সম্পর্কও হতে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ, দুর্বল আমলাতন্ত্র, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অতিকেন্দ্রিকতা এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে অনীহার কারণে ভারতের সঙ্গে আমরা দর-কষাকষি শক্তি অনেকটুকু হারিয়েছি।

এ সুযোগে বাংলাদেশ থেকে বহু একতরফা সুবিধা নিচ্ছে ভারত। ফেনী চুক্তিসহ এবার স্বাক্ষরিত অন্য সমঝোতাগুলো এর নতুন উদাহরণ মাত্র। এসব অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারত নিয়ে অস্বস্তি আরও বাড়বে।

দীর্ঘ মেয়াদে দুই দেশের সম্পর্কে এর নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। আবরারের হত্যাকাণ্ডের পর মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় সেই ইঙ্গিত রয়েছে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক