সরকারের দায় নিয়ে কথা বলতে হবে

আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় ১০ দফা দাবিতে বুয়েটের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। বুয়েট, ঢাকা, ৯ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম
আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় ১০ দফা দাবিতে বুয়েটের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। বুয়েট, ঢাকা, ৯ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে হত্যা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। আবরারকে হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে তাঁর প্রতিক্রিয়ার কারণে। হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘শিবির’-এর সমর্থক বা সদস্য হিসেবে। গত রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে নিহত আবরারকে নিয়ে যেকোনো ধরনের কথা বলতে হলে এই তর্কাতীত সত্যগুলো স্বীকার করেই বলতে হবে। এর যেকোনো একটি অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে এই হত্যার দায় থেকে ব্যক্তি, সংগঠন, সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রকে দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা। সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখে শোকপ্রকাশ ও ক্ষুব্ধ হওয়ার ভঙ্গি করাকে কেবল মায়াকান্না বললেই যথেষ্ট হবে না, অমানবিক আচরণ বলেই বর্ণনা করতে হবে।

অনেকেই বলতে পারেন, আবরারকে হত্যা করা হয়েছে—এটা কেন বলতে হচ্ছে? এটা কি আমরা জানি না? বলতে হচ্ছে, কেননা, তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ একে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলেই মনে করছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গত সোমবার যে জরুরি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘আবরার ফাহাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে একটি জিডি করা হয়েছে’ (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জরুরি বিজ্ঞপ্তি, নম্বর সংস্থা/ব-২৩/রে-১৯৮৬ (২০০), তারিখ ০৭/১০/২০১৯)। আমি এই প্রশ্ন করতেই পারতাম যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো শিক্ষার্থীর কোনো মৃত্যু কি কাঙ্ক্ষিত যে একে অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই দায় সারা হচ্ছে? আমি এ বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু এ ভাষা থেকে মনে হচ্ছে যেন আবরারের মৃত্যু ঘটেছে বজ্রপাতে, সর্পদংশনে অথবা পানিতে ডুবে। শুধু তা-ই নয়, এ জন্য কর্তৃপক্ষ একটি ‘জিডি’ করেছে। একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কি জিডি করতে হয়? আমার সাধারণ জ্ঞান বলে, এটা হচ্ছে একধরনের রসিকতা মাত্র। আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে আমার জ্ঞানের অভাব আছে; সে কারণেই বাংলাদেশের একাধিক শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী ধারায় মামলা করতে পারত? তাঁরা দ্বিধাহীনভাবেই বলেছেন, দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা করা যেত, অন্ততপক্ষে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা করা যেত।

কেবল কোন আইনের ধারায় মামলা করা হয়েছে, সেটাই বিষয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের যে দৃষ্টিভঙ্গি ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট, তাতে মনে হয়, এ হত্যাকাণ্ডের কোনো দায় তাদের নেই। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, প্রক্টর, ছাত্রাবাসের প্রাধ্যক্ষরা তাঁদের দায়িত্ব হিসেবে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের রক্ষা করা, তাঁদের সঙ্গে অর্থ ভাগাভাগি করা এবং দরকারমতো তাঁদের সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া। কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যেসব বিষয় সবার জানা হয়েছে, তাতে এটাই মনে হয় নিয়ম। সেই ধারাবাহিকতায় হত্যার দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপটি কার্যত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই নিয়েছে।

কীভাবে আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়েছে, তার কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পেটানো হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি মারা না গেছেন। এ পেটানোর কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। এ পর্যন্ত ১৩ জনকে পুলিশ আটক করেছে। কিন্তু এ ঘটনা কি কেবল এই প্রথমবারের মতো ঘটল? এই প্রথমবারের মতো ছাত্রলীগের একটি শাখার কয়েকজন ঘটিয়েছেন? যাঁরা একে কয়েকজন অতি উৎসাহীর কাজ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের কাছে জানতে চাইতেই হচ্ছে, গত ১০ বছরে এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত ছিলেন না? তাঁদের না–করা অপকর্মের তালিকা করে দেখতে পারেন, সেটাই সহজ হবে।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠার পরে তাঁরা পদচ্যুত হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে একটি মামলা পর্যন্ত হয়নি। ছাত্রলীগের নেতাদের আইনের ঊর্ধ্বে ওঠার শুরু হয়েছিল কবে, সেটা যদি মনে না পড়ে, তবে ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রথম আলো পড়ে দেখতে পারেন। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লিখেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’। এর আগেও একই শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলেন তিনি (প্রথম আলো, ৯ মে ১৯৯৯) ছাত্রদলকে নিয়েও লিখেছিলেন দুটি লেখা: ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদলকে সামলান’ (প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ২০০১) ও ‘প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদলকে সামলাতে পারেননি’ (প্রথম আলো, ৮ আগস্ট ২০০৩)। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সাংগঠনিক নির্দেশনা আছে কি না, সেটা অর্থহীন প্রশ্ন। সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ যদি এ ধরনের তৎপরতাকে তাদের কাজ বলে বিবেচনা না করে, তবে কীভাবে ১০ বছর ধরে সারা দেশে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? সে কারণেই এ হত্যার দায় কেবল এই কয়েকজন কথিত কর্মীর নয়, কেবল বুয়েট শাখার নয়, এই দায় সংগঠন হিসেবেই ছাত্রলীগের, এ সংগঠনের তদারকি যাঁরা করেন, এ দায় তাঁদের। আবরারের রক্ত তাঁদের হাতেও লেগে আছে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি এর দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারে?

গত শনিবার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে নয় বলে অনেকের ধারণা। আমি নিজেও তা–ই মনে করি। কিন্তু কেউ কেউ এগুলোর পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। সেই অধিকার তাঁদের আছে। আবরার এসব চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কঠোর সমালোচনার অধিকার থাকা সত্ত্বেও তিনি যতটুকু মনে হয়েছে, ততটুকুই লিখেছেন। তারপরও এ বিষয়ে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করার নামে ডেকে নিয়ে সরকার–সমর্থকেরা তাঁকে পিটিয়েছেন—যতক্ষণ না পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়; উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিন্নমতের জন্য প্রাণনাশ হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলার পরিণতি ভালো হয়নি। ভিন্নমতের জায়গা সীমিত হতে হতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। যে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনেরা কেবল শক্তির জোরে শাসন করে, সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা থাকে না। এর সীমা এখন দেশের বাইরেও প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু এখন এ ঘটনা থেকে কি এই শিক্ষা নিতে হবে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কথা বলার দরজা বন্ধ? তাহলে কি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের করা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ত্রুটি নিয়ে কথা বলা যাবে না, নাকি তা কেবল ভারতের বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে?

কাউকে কথিত ‘শিবির’ সন্দেহে সরকার–সমর্থকেরা এই প্রথম আক্রমণ করলেন বা হত্যা করলেন তা নয়, গত আট বছরে এমন ঘটনার সংখ্যা বেশুমার। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে শিবির–সমর্থক বলে পেটানোর পরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও আছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করেছে। ‘ছাত্রশিবির’ কি নিষিদ্ধ সংগঠন যে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে? সেই অজুহাতে কাউকে হত্যার লাইসেন্স কে কাকে দিয়েছে? এ অধিকার আসলে প্রকারান্তরে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীন দলই তার কর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার এ ধারা তৈরি করে তা তুলে দিয়েছে দলের হাতে। যেখানে দল, সরকার ও রাষ্ট্র একাকার হয়ে যায়, সেখানে এটাই হওয়ার কথা। দলের একেবারে নিম্নতম পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত জানেন, যেকোনো ধরনের নির্যাতন ও হত্যা বৈধ করার এটাই হচ্ছে উপায়। একে বৈধতা দেওয়ার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে থাকেনি।

দুর্ভাগ্যজনক এই যে অনেকেই এখন আবরারের পরিবার আওয়ামী লীগ–সমর্থক—এ কথা জোরেশোরে বলছেন। তাঁদের এ আচরণ থেকে বোঝা যায়, ভিন্নমতের প্রতি, সরকারের সমালোচকদের প্রতি তাঁদের মনোভাব কী। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁরাও যে ভিন্নমতের পথে বাধা হয়ে উঠছেন, তাঁরা কি তা বুঝতে পারছেন? তাহলে কি কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে, পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেই ভিন্নমত পোষণ করা যাবে, প্রকাশ করা যাবে? অন্যথায় করা যাবে না?

আবরার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যদি সত্যি কেউ প্রতিবাদ করতে চান, তবে যে সত্যগুলো দিবালোকের মতো বিষয়, সেগুলো আগে স্পষ্ট করে বলুন।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর