ভাষায় অসভ্যতা এবং আমাদের নীরবতা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি টেলিভিশন টক শো উপভোগের আমন্ত্রণ জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন স্বয়ং অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। সঞ্চালক এবং আলোচকদের ছবিসহ পোস্টটি ছিল বেশ আকর্ষণীয়। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন একজন নারী। আমি পোস্টটির মন্তব্যগুলো পড়া শুরু করলাম। দেখলাম সেখানে নারী আলোচকের সৌন্দর্য নিয়ে এরই মধ্যে নির্লজ্জ গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবাদ জানালাম আমি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। অন্য নারীর সৌন্দর্যে ঈর্ষাপরায়ণ একজন নারী হিসেবে আমাকে চিত্রিত করা হলো, নারীবাদী হিসেবে গালি দেওয়া হলো, নোংরা ভাষার প্রয়োগে রক্তাক্ত করা হলো। সঞ্চালক বন্ধুকে জানিয়েছিলাম বিষয়টি। সাহসিকতার জন্য তিনি আমাকে বাহবা দিলেও যখন আমি তাঁকে এ ধরনের অপ্রীতিকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অনুরোধ জানালাম, তখন তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। তিনি জানালেন, মন্তব্যকারী ব্যক্তিটি তাঁর ছোটবেলার বন্ধু। নৈতিকভাবে তিনি আমাকে সমর্থন করলেও প্রতিবাদ করা থেকে তিনি নিজেকে বিরত রাখলেন। 

এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার কিংবা আমাদের মতো অনেক নারীর জন্য নতুন নয়। বিভিন্ন চ্যাট বক্সের কথোপকথনের অভিজ্ঞতা যদি বাদও দিই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের মন্তব্যে হেয়প্রতিপন্ন করা হয় নারীকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি অপমানজনক ও যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কুরুচিকর মন্তব্যের প্রাবল্য একটি জাতির মানসিক সুস্থতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বিবেকবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে যে আট কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন, তার বড় অংশই নারী। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অধিকাংশই কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরুষকে যত জোরালোভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে দেখা যায়, নারীকে সেই ভূমিকায় দেখা যায় না। কারণ, পাবলিক পোস্টে মন্তব্যের ক্ষেত্রে নারী প্রায়ই নানা ধরনের আজেবাজে মন্তব্যের শিকার হন। 

আমরা নারীরা যাঁরা বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত লেখালেখি করি, তাঁদের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই হজম করতে হয় এসব অরুচিকর মন্তব্য। এসব মন্তব্যের ভাষা এতটাই কুরুচিপূর্ণ, যা উচ্চারণের অযোগ্য। প্রকাশিত মন্তব্যগুলোতে দেখা যায় লেখার বিষয়বস্তু গৌণ হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মুখ্য হয়ে ওঠে লেখকের নারীসত্তা, যা লেখার বিষয়ের সঙ্গে মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়। কেউবা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন, গালিগালাজ করেন, কেউবা লেখকের পোশাক কিংবা জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, এমনকি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের হুমকি দিতেও কার্পণ্য করেন না অনেকে। এসব মন্তব্যকারীর প্রোফাইল ঘুরে দেখেছি এঁদের অনেকেই শিক্ষিত এমনকি উচ্চশিক্ষিত। নারীরাও যে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন না, তা নয়। কিন্তু সেই সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। 

নারীর প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের ভাষার প্রয়োগ বিচ্ছিন্ন কোনো মানসিকতা নয়। বরং ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ফলে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। আসলে আমরা এমন একটি সামাজিক চর্চার মধ্যে আছি, যেখানে অনেকেই নারীকে হেয়প্রতিপন্ন, ব্যঙ্গবিদ্রূপের বিষয়বস্তু হিসেবে গণ্য করতেই অভ্যস্ত। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে নারীর দায়িত্বের পরিধি আর তাঁর সামাজিক অবস্থান। 

কিন্তু এ পরিবর্তনের ব্যাপারে আজও অনেকে সচেতন নয়। অনেকে এখনো মেনে নিতে পারছেন না নারীর নতুন এ অবস্থান। ফলে সুযোগ পেলেই উন্মুক্ত যোগাযোগমাধ্যমে নানা মন্তব্য ছুড়ে কিছু পুরুষ নারীর প্রতি তাঁর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছেন। 

আরেকটি বিষয় হলো, আমরা অধিকাংশই নারীর প্রতি অপমানজনক ভাষার ব্যবহারে নীরবতা পালন করছি। প্রতিবাদহীনতার এ সংস্কৃতি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের এ প্রবণতাকে যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, অনেক পুরুষ আছেন, যাঁরা নারীর প্রতি ভাষার এ আগ্রাসনকে ঘৃণা করেন। কিন্তু নারীর পক্ষে লড়াইয়ের ঝুঁকি তাঁরা নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, এতে তিনি অনেকের কাছে হাসির পাত্র হবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে পুরুষ নারীর অপমানে মৌন থাকেন, সেই পুরুষ কখনো কোনো নারীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন না। মনে রাখা প্রয়োজন, যা কিছু মন্দ, তার সঙ্গে আপস করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই, বরং রয়েছে লজ্জা। 

আমাদের দেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতার রাশ টেনে ধরার জন্য রয়েছে নানা আইন, যেমন তথ্যপ্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন কিংবা নারী নির্যাতন দমন আইন ইত্যাদি। কিন্তু শুধু আইন দিয়ে সমাজ পরিবর্তন কখনো সম্ভব নয়। সামাজিক পরিবর্তনে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আমরা যাঁরা নারীর অপমানে নীরব থাকি, আমাদের এই নীরবতার দায় হয়তো ভোগ করছেন আমাদের খুব কাছের নারীটি। নারীর প্রতি অসম্মানজনক উক্তিকারীদের সামাজিকভাবে প্রতিহত ও বর্জন করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি ভাষা-সন্ত্রাস অচিরেই বন্ধ হোক। 

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক