রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছাত্র সংসদ হোক: আল-নকীব চৌধুরী

আল-নকীব চৌধুরী
আল-নকীব চৌধুরী
>আল-নকীব চৌধুরী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বুয়েটের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: বুয়েটের শৃঙ্খলা কমিটি সাম্প্রতিক দিনগুলোতে অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই কার্যকর হয়নি। আদালতেও আটকে গেছে। আপনি কীভাবে দেখছেন? 

আল-নকীব চৌধুরী: বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত আদালতের রায়ে উল্টে গেছে। সুতরাং শৃঙ্খলামূলক সিদ্ধান্ত নিতে আইনগত দিকগুলো ভালোভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হয়, তাহলে প্রশাসনিক দুর্বলতা সামনে চলে আসে।

প্রথম আলো: সেগুলো যথাযথ হয়নি বলেই যে উল্টে গিয়েছে, তা আপনি কীভাবে নিশ্চিত?
আল-নকীব চৌধুরী: আমি সেটা বলতে চাই না। আদালতের সিদ্ধান্তই তো সর্বোচ্চ রায়। সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে। সেখানে ভালো-মন্দ বিচারের প্রশ্ন থাকে না। তাই সিদ্ধান্তটা পরিপক্ব হতে হবে, যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

প্রথম আলো: আপনি আপনার ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কখনো শুনেছেন যে কেউ বাস্তবে আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছেন? সাসপেন্ডেড সেন্টেন্স প্রথা কোনো সুফল দিল কি?
আল-নকীব চৌধুরী: আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে এটা একটা কৌশল হতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে তোমাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এটা স্থগিত থাকে। এটা এই ভাবনা থেকে করা হয়, যাতে তারা সংশোধন হয়, যাতে তারা অনুতপ্ত হয়। যদি তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। আবার কখনো এমন অনেক কিছু বিষয় থাকতে পারে, যা সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায় না। এটা অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের স্বার্থে।

প্রথম আলো: এবার যে ঘটনা ঘটেছে, ধরুন সিসিটিভির ফুটেজ, সেখানে কিছু বিষয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কারা কীভাবে জড়িত। ফুটেজের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?
আল-নকীব চৌধুরী: আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান যে কাঠামো আছে, তার আওতায় সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা অসম্ভব বলে মনে হয় না।

প্রথম আলো: আপনি ৩০ বছরে যা দেখেননি, সেটা কেন এখন সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন?
আল-নকীব চৌধুরী: আশা তো আমাদের করতেই হবে। অতীতে কেউ ব্যর্থ হয়েছে বলে বর্তমানে ব্যর্থ হবে, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। এবারে একটা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে বলে আমি বিশ্বাস রাখতে চাই।

প্রথম আলো: এখন কথা উঠেছে, বুয়েটে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি নিয়ে। অথচ গত দুই দশকে বুয়েট ছাত্র সংসদ  নির্বাচন হলো না। জোরেশোরে দাবিদাওয়া পর্যন্ত নেই। কেন? এটা ঠিক কিসের ইঙ্গিত?
আল-নকীব চৌধুরী: বিষয়টি ছাত্রকল্যাণের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষার্থীদের অধিকার, তাদের স্বার্থ, তাদের পড়াশোনা অনেক কিছুই এই ছাত্র সংসদের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হতে পারে। এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার আকাঙ্ক্ষা কিন্তু শিক্ষার্থীদের দিক থেকেই আসার কথা। এ ধরনের সংসদ ক্যাম্পাসে থাকা বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি। এটা অনেক গণতান্ত্রিক এবং সেটা শিক্ষার্থীদের একটা শক্তিশালী মঞ্চ হতে পারে। শিক্ষার্থীরা সংসদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে এমন কিছু তৈরি করতে পারবে, যেসব দেশ জাতির জন্য অনেক উপকার বয়ে আনতে পারে।

প্রথম আলো: শিক্ষার্থীদের দলীয় অঙ্গসংগঠন থাকার বিলোপ চান কি না?
আল-নকীব চৌধুরী: বুয়েট শিক্ষকেরা যেহেতু সর্বসম্মতক্রমে শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই আমি বলব, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি সর্বজনীন, কল্যাণমুখী ছাত্র সংসদের পুনরুজ্জীবন প্রত্যাশিত।

প্রথম আলো: অন্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বুয়েটে সহিংসতা ও দলাদলি কম। কিন্তু পরীক্ষা পেছানোর মতো কারণে এখানে একটু বেশি মাত্রায় শিক্ষকেরা আক্রান্ত হন। সামাজিক অবক্ষয়?
আল-নকীব চৌধুরী: সেটা একটা কারণ হতে পারে।

প্রথম আলো: আজকের এই পরিস্থিতির জন্য কেউ বলছেন ক্ষমতার রাজনীতি দায়ী, কেউ বলছেন জাতীয় রুগ্ণ রাজনীতি বা লেজুড়বৃত্তির কথা। আপনি কীভাবে দেখেন?
আল-নকীব চৌধুরী: বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে মতামত দিতে পারেন। তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকা উচিত। এসব মন্তব্যে যদি কিছু শিক্ষণীয় থাকে, তাহলে সেটা নিতে হবে।

প্রথম আলো: বুয়েটে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এবং শিক্ষক দলাদলি নেই। কিন্তু তাই বলে কি বুয়েট রুগ্ণ রাজনীতিমুক্ত?
আল-নকীব চৌধুরী: অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যাবে, এই সমস্যা বুয়েটে এখনো এতটা প্রকট নয়। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে কোনো প্যানেল হয় না। একটা নির্বাচন কমিশন থাকে। আগ্রহী প্রার্থীরা বুয়েটে নির্বাচন করতে পারেন। যদিও এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শগত লোক রয়েছেন। সেটা থাকাই তো স্বাভাবিক।

প্রথম আলো: বিশ্বসেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বুয়েট কেন নেই? এর ব্যাখ্যা কী?
আল-নকীব চৌধুরী: ওই পর্যায়ে যেতে যতগুলো ভালো প্রকাশনা দরকার, ততটা হয়তো আমাদের শিক্ষকেরা এখনো অর্জন করতে পারেননি। তবে সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। হেকেপ প্রকল্পের অধীনে নতুন ল্যাব উপকরণ আসছে। শিক্ষকদের ভালো মানের প্রকাশনা বেড়েছে।

প্রথম আলো: একজন শিক্ষক বলেছেন, বিশ্বমানের স্বীকৃত সাময়িকীতে নিবন্ধ ছাপানোর দরকার পড়ে। কিন্তু সে জন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার ডলার ফি লাগে। কিন্তু বুয়েট এটুকু খরচের জোগান দিতে পারে না। কারণ, গবেষণায় বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল।
আল-নকীব চৌধুরী: সেটা সঠিক। তালিকাভুক্তি বড় নয়, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় দেশকে এগিয়ে নিতেই প্রযুক্তিগত ও বিজ্ঞানের গবেষণায় বুয়েট শিক্ষকদের ঋদ্ধ হতে হবে। উপাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিটি ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ (সিএএসআর) গবেষণার বিষয়টি দেখভাল করে। গবেষণা খাতে সার্বিকভাবে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। বাস্তবতা বোঝাতে একটি উদাহরণ দিই। ১৯৯৬ সালে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের প্রতি ছাত্রের জন্য গবেষণা ব্যয় ছিল ৮০ হাজার টাকা। ২৩ বছর পরে সেখানে সেই বরাদ্দ এখন হ্রাস পেয়ে মাত্র ৫০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।

প্রথম আলো: আপনি নিজেও উপাচার্য ছিলেন। উপাচার্যের পদত্যাগেই বুয়েট সংকট মিটবে?
আল-নকীব চৌধুরী: আবরার হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী চরম সংকটে উপাচার্যের যতটা সম্পৃক্ততা, যতটা উদ্যোগী হওয়া সমীচীন ছিল, বিভিন্ন মহলের যতটা প্রত্যাশা ছিল, সেখানে ঘাটতি ছিল। তাঁর নির্লিপ্ততা সবাইকে ব্যথিত করেছে। তাই আবরারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তিনি বাধার মুখে পড়েন। তদুপরি বুয়েটের চলমান সংকট বিষয়ে তাঁর নিজের বলার কিছু থাকলে নিশ্চয় তিনি সেটা বলবেন। এ জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দ্রুত বসতে পারেন। তবে আমি মনে করি, নিজের সম্মানবোধ এবং সার্বিক পরিস্থিতি তাঁর জন্য এখন একটা জরুরি বিচার-বিবেচনার বিষয়। তিনি বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে অতি দ্রুত যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই বুয়েট শান্ত হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আল-নকীব চৌধুরী: ধন্যবাদ।