মানবিক গুণাবলির বিলুপ্তি মানবতার মৃত্যু

মহান আল্লাহ তাআলা কুল মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন ভালোবেসে। জিন–ইনসান বানিয়েছেন ইবাদতের জন্য। মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে, যাতে মানুষ আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে সৃষ্টির কল্যাণে ও সেবায় নিবেদিত হয়। এই মহান দায়িত্ব পালনে যাঁরা সফল হবেন, তাঁদের সম্মানিত করবেন বেলায়াত বা বন্ধুত্বের মর্যাদায়। তাঁদের জন্য রয়েছে জান্নাতের নিয়ামত। ইসলাম মানবতার ধর্ম, ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। জগতের সব মানুষের দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ ও অনন্য পন্থা।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা হিসেবে মনোনীত করেছেন। মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্ব তার ‘ইলম’, তথা বুদ্ধিবিবেক বা জ্ঞানের জন্য। এই জ্ঞানের জন্যই মানুষ ফেরেশতাদের নমস্য হয়েছে। মানুষকে মহান আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন চিন্তার স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য। তাই মানুষের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মানুষ পরিচালিত হয় তার স্বীয় ইচ্ছার অনুকূলে। মানুষ ভালো–মন্দ বিচার করে যার যার জ্ঞানের আলোকে। জ্ঞানের ভিত্তি হলো তথ্য। তথ্যের অবাধ প্রবাহ বা আদান–প্রদান জ্ঞান বিকাশে ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আল্লাহ তাআলা সব নবী–রাসুলকে সত্য তথ্য প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, জোর করে বাধ্যতামূলক বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়।

আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘(হে রাসুল!) আপনি উপদেশ দিন, আপনি উপদেশদাতা ভিন্ন নন। আপনি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নন। তবে যারা মুখ ফিরিয়ে নেবে ও কুফরি করবে, আল্লাহ তাদের মহাশাস্তি দেবেন। তারা আমার কাছেই ফিরে আসবে এবং তাদের হিসাব গ্রহণ আমারই দায়িত্বে’ (সুরা-৮৮ গশিয়াহ, আয়াত: ২১-২৬)।

মানুষ মানবীয় গুণাবলিতে সুসজ্জিত হলেই সে সৃষ্টির সেরা। মানুষ যখন পশুর স্বভাব–চরিত্র ধারণ করে, তখন সে জন্তু–জানোয়ারের চেয়েও অধম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর (তাদের কতককে তার স্বভাবদোষে) সর্বনিম্নে নিপতিত করেছি’ (সুরা-৯৫ তিন, আয়াত: ৪-৫)।

ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও উদারতা এবং ক্ষমা ও দয়া মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ গুণ। আল্লাহ তাআলা চান, তাঁর গুণাবলি বান্দার মধ্যে বিকশিত হোক। এতে মানবিক গুণসম্পন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠে। যখন এই উত্তম গুণাবলির বিলোপ সাধন ঘটে; ধৈর্যহীনতা, অসহিষ্ণুতা, সংকীর্ণতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, দম্ভ ও অহংকার সমাজকে আচ্ছন্ন করে, তখন মানবতার মৃত্যু ঘটে। মানুষের মধ্যে পাশবিকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘তাদের রয়েছে অন্তর, কিন্তু তা দিয়ে তারা অনুভব করে না, তাদের চক্ষু রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখে না, তাদের কর্ণ রয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না; তারা পশুতুল্য বরং তারও অধম’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ১৭৯)।

শান্তি প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণসমাজ গঠনে উদারতা, সহিষ্ণুতা এবং ক্ষমা ও দয়ার আচরণ অপরিহার্য। কারও সঙ্গে দ্বিমত, ভিন্নমত বা মতপার্থক্য হলে তা সুন্দরভাবে যুক্তি–প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্ত দ্বারা বুঝিয়ে বলতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান নয়, তুমি প্রতিহত করো মন্দকে তা দিয়ে, যা উত্তম; ফলে তোমার ও যার মধ্যে চরম শত্রুতা, সে তোমার পরম বন্ধুতে পরিণত হবে’ (সুরা-৪১ হা–মিম সাজদাহ, আয়াত: ৩৪)।

জ্ঞান হলো মানবতার সুরক্ষার জন্য। শিক্ষা হলো মানবিক উৎকর্ষ সাধন ও ইতিবাচক আচরণ অনুশীলনের জন্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে সহায়তার নিমিত্তে। এই তিনের সমন্বয়ে নির্মিত হয় সভ্যতা, গঠন হয় সুসভ্য জাতি। যে প্রযুক্তি মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হয় না, যে শিক্ষা মানুষকে মানবিক গুণসম্পন্ন করে না, সে প্রযুক্তি ও শিক্ষা মূল্যহীন।

যাঁদের মধ্যে মানবিকতা আছে, তাঁরা জীবিত আর যাঁদের মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই, তাঁরা মৃত। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘নিশ্চয় আপনি মৃতকে (জাতি) শোনাতে পারবেন না আর বধিরকেও শোনাতে পারবেন না; যখন তারা পেছনে ফিরে যায়’ (সুরা-২৭ নমল, আয়াত: ৮০)।

যখন কোনো জাতির সন্তানদের মানবিকতার মৃত্যু ঘটে, তখন সে জাতি মৃত জাতি। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মানুষ হত্যার বিনিময় ছাড়া অথবা দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টির উদ্দেশে্য কোনো মানুষকে খুন করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবতাকে রক্ষা করল’ (সুরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৩২)।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]