ধান চাষে অনীহা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি

মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা এখনো প্রাসঙ্গিক। নগরায়ণ, শিক্ষিত ও সচ্ছল ব্যক্তিদের বিকল্প খাদ্যের ওপর জোর ইত্যাদি কারণে গড়পড়তা চালের চাহিদা খানিকটা কমলেও জনসংখ্যা ১৭ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর সেটা ক্রমবর্ধমান। তাদের বিশাল অংশের ক্যালরি চাহিদার প্রধান উৎস ভাত। জনসংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত ছোট আমাদের দেশ। আর ধান চাষযোগ্য সে জমিও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে আবাসন, শিল্পায়নসহ অনেক কারণে। অন্যদিকে শস্যবহির্ভূত ফল, ফুল কিংবা মাছ চাষের জন্যও কমছে জমির পরিমাণ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) উদ্ধৃত করে একটি ইংরেজি দৈনিক লিখেছে, ১৯৮০ সালে যেখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১০ লাখ একর, তা ২০০৭–তে নেমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ একরে। নিশ্চিতই তা এখন আরও বেশ কমেছে। তবে এ দেশের সব সময়ের সরকারগুলো কৃষি উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীরা সাধ্যমতো প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সর্বোপরি হার মানতে না জানা বাংলার কৃষক ব্যাপক খাটুনি দিয়ে সেই কম জমিতেই উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষি উপকরণ দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন। দীর্ঘদিনের খাদ্য ঘাটতির দেশটি আজ প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে সামান্য কিছু উদ্বৃত্তই ফলাচ্ছে। তবে অবস্থাটি টেকসই বলা যাবে না। আমাদের চাষাবাদ ব্যবস্থা বহুলাংশে প্রকৃতিনির্ভর। বৈরী প্রকৃতির প্রকোপে দ্রুতই কোনো কোনো সময় হয়ে পড়ে কিছু ঘাটতির দেশে। সে ঘাটতি মোকাবিলা করা যে কত কঠিন, তা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন। গত কয়েক বছর ধানের দামের অস্বাভাবিক হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয় কৃষককে নাকাল করে ফেলেছে। অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু চাল রপ্তানির অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। তাতেও অবস্থার ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। মুখ থুবড়ে পড়া ধানের দাম চাষাবাদ ব্যয়ের বেশ নিচেই থেকে যাচ্ছে। স্বল্প পরিমাণে বাদ দিলে বেশির ভাগ কৃষক অল্প জমির মালিক কিংবা ভাগচাষি। একটি মৌসুমের লোকসানও তাঁদের ঋণগ্রস্ত করে ফেলে। এমনই একটি পরিস্থিতিতে কৃষককুল খুব স্বাভাবিকভাবেই ধান চাষে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ছে। দেশের শস্যভান্ডার বলে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার ধানের জমি ক্রমান্বয়ে আমবাগানে পরিণত হচ্ছে। বেশ পরিমাণ জমি যাচ্ছে মত্স্য চাষ ও শাকসবজি উৎপাদনে। এগুলো সবই প্রয়োজনীয়। তবে ধান চাষের বিকল্প হতে পারে না। যে হারে জমি কমছে, সে হারে ধানের উৎপাদন ক্ষমতা আরও বাড়ানোর সুযোগ খুব কম। চালের ওপর বড় ধরনের নির্ভরশীলতাও সহসা কাটবে না।

ইংরেজি একটি দৈনিকের প্রতিবেদন বলছে, পেশা পরিবর্তনের সুযোগের অপেক্ষায় আছেন অনেক ভাগচাষি। কেউ কেউ করেছেনও। সরকারিভাবে কেনার জন্য ধান–চালের দাম ধরা আছে যথাক্রমে ২৬ ও ৩৬ টাকা। সে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান বিক্রির সুযোগ পান নগণ্যসংখ্যক লোক। আমাদের চাল উৎপাদন ৩ কোটি ৬২ লাখ টন। বোরো মৌসুমেই এটা প্রায় ২ কোটি কম। অথচ সাইলোসহ সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা ২১ লাখ টন। সেখানে কিছু গমও রাখতে হয়। ২০২৫ সাল নাগাদ এ ধারণক্ষমতা ৩০ লাখ টনে উন্নীত করার একটি পরিকল্পনা সরকারের আছে। তবে যন্ত্রসভ্যতার সুফল ভোগ করছেন আমাদের আধুনিক চালকলের মালিকেরা। তাঁরা ব্যাংকঋণ নিয়ে বড় মজুত গড়ে ধান–চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন। বাজারে বড় ক্রেতা তাঁদের ধান সরবরাহকারীরা। আর বিক্রেতাও চালকলের মালিকেরাই। ভেবে দেখুন, ধান চাষ থেকে বড়সংখ্যক লোক মুখ ফিরিয়ে নিলে কী হবে!

এটা সত্যি মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দিয়ে দেশের আর্থিক সক্ষমতার চিত্র সামনে আসে। তবে পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। ফলে সমাজে বেড়ে চলেছে আর্থিক বৈষম্য। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান এখন ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। সে সংস্থাটিরই তথ্যানুসারে এ খাতে শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। সুতরাং জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান যতই হোক না কেন, খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান বিবেচনায় এটা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত বললে বাড়াবাড়ি হবে না। হয়তোবা সেবা খাত জিডিপিতে ৫২ দশমিক ৮৫ শতাংশ অবদান রেখে শীর্ষে রয়েছে। এটা অর্থনীতির ভালো দিক। তবে এ সেবা খাতের সম্প্রসারণেও কৃষির ভূমিকা ব্যাপক। বৃহত্তর সংজ্ঞায় কৃষির আওতায় মত্স্য, পশুসম্পদ, বন সবই আছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনজনিত কারণে মাথাপিছু চালের চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমবে। তবে যতটুকু কমে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তার চেয়ে বেশি। এটা স্থির হয়ে গেলে এবং উন্নত দেশের উন্নত জীবনযাত্রা অর্জন করলে খাদ্য হিসেবে চালের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমবে। তত দিনে চাষের জমির পরিমাণও অনেক কমে আসবে। উন্নততর প্রযুক্তি ও ফলন একটি মাত্রার ঊর্ধ্বে নিতে পারবে না। তাই আমাদের ধান চাষকে আকর্ষণীয় করতে নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

কৃষিপণ্য সব দেশেই নিত্যপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো কট্টর পুঁজিবাদী দেশও সুলভ প্রাপ্তির জন্য উৎপাদনকারীদের নানামুখী প্রণোদনা দিয়ে চলেছে। ফলে এত বেশি আয়ের লোকের দেশেও রুটি, চাল, সবজি, দুধ, দুগ্ধজাত পণ্য, মুরগি, ডিমের দাম অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। আমরাও অনেকটা সুলভেই চাল পাচ্ছি, তবে কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে। মধ্যস্বত্বভোগীরা এখানে বড় রকম নেতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁরা ধান উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থেকেও কৃষককে আজ কাবু করে ফেলেছেন। আবার একটু ঘাটতির সুযোগ পেলে তা করেন ভোক্তাকে। এদের ওপর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শোচনীয় রকমের দুর্বল। এ ছাড়া কৃষকদের জন্য সরকার যে ধরনের প্রণোদনা দিয়ে চলেছে, তা সময়ের তুলনায় অপ্রতুল মনে হচ্ছে। সব ধান সরকারের কিনে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই তাদের ঘাটতি নগদ ভর্তুকির মাধ্যমে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য। বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থাতেই ইউনিয়ন পরিষদ ও কৃষি সম্প্রসারণকর্মীদের নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন এটা করতে পারে। কম মূল্যে বীজ, সার সবই দিচ্ছে। এর বিনিময়ে কৃষকও কিন্তু দিচ্ছেন ফসল। খাতটি ধরে রেখেছে বিশাল শ্রমশক্তি। এটা যেকোনো সরকারের জন্য কম স্বস্তির বিষয় নয়। এটাকে ধরে রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ দরকার। অন্যথায় মানুষের জীবনে সর্বাগ্রে প্রয়োজনীয় খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। সেটা হবে জাতির জন্য বিপর্যয়কর।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]