ছাত্ররা কেমন রাজনীতি করবেন

আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আন্দোলনে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। বুয়েট, ঢাকা, ১১ অক্টোবর। ছবি: দীপু মালাকার
আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আন্দোলনে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। বুয়েট, ঢাকা, ১১ অক্টোবর। ছবি: দীপু মালাকার

বুয়েটে ‘সাংগঠনিক রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে, তা মোটের ওপর ইতিবাচক। অধিকাংশ মানুষ এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন। অনেকে এই বলে স্বস্তি প্রকাশ করছেন যে এখন থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতিই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হবে; মারামারি, দলাদলি এসব বন্ধ হবে। বুয়েট ক্যাম্পাসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের প্রয়োজন আর থাকবে না।

অবশ্য এমন সংশয়বাদী মানুষের দেখাও পেয়েছি যাঁরা বলছেন, কাগজে-কলমে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, বুয়েটসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে কোনো পরিবর্তন আসবে না; সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বলপ্রয়োগের চর্চা বন্ধ হবে না। কারণ, বিষয়টা গভীরভাবে রাজনৈতিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের আধিপত্য চলছে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছায়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যেসব বেআইনি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত ও সমালোচিত হচ্ছেন, সরকারের অনুমোদন না থাকলে তাঁদের পক্ষে সেগুলো চালানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলে হলে দেশের প্রচলিত আইনকানুন ও বিচারের ব্যবস্থার ধরাছোঁয়ার বাইরে যে নিষ্ঠুর ও বিপজ্জনক নির্যাতনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা গড়ে ওঠা অসম্ভব ছিল, যদি সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটাকে প্রশ্রয় না দিতেন।

বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে যখন শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কয়েকজন নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন চকবাজার থানার একজন উপপরিদর্শক খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাদের বাধার কারণে তিনি আবরারের কাছে পৌঁছাতে পারেননি; হলের অভ্যর্থনাকক্ষে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে থানায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের অপরাধ সংঘটনের মুহূর্তে দেশের আইন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ ও আইনপ্রয়োগের ব্যবস্থা কী বিপজ্জনকভাবে নিষ্ক্রিয় ও অকার্যকর হয়ে যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে এ পর্যন্ত যত শিক্ষার্থী খুনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর কোনোটারই বিচার কেন হয়নি, এমনকি কোনো কোনো খুনের মামলার রায়ে খুনিদের কেন খুঁজেই পাওয়া যায়নি—তা-ও এই ঘটনায় আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর জন্য দায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র-শিক্ষকদের বিষয়ে সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের একান্তই দলীয় স্বার্থতাড়িত দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান।

এই দেশে যখন যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় কিংবা নেয়, তখন সেই দল অঘোষিতভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের অনুগত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে বলপ্রয়োগ ও নিষ্ঠুরতার চর্চা চলে এসেছে, তারই ভয়ংকর রূপ আবরার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আরও একবার উন্মোচিত হলো। এখন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাদের কক্ষ সিলগালা কিংবা আবরারের হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেই এই গুরুতর সমস্যার সমাধান হবে না; কাগজে-কলমে সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেও বস্তুত কোনো কাজ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান বদলাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের দলভিত্তিক রাজনৈতিক আনুগত্য বা সমর্থন লাভের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত কোনো কিছুতেই কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করা যায় না।

কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি এই আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করবে? বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ রকম আশা করা কি বাস্তবসম্মত? মনে হয় না। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা, জ্ঞান, সংস্কৃতির গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। বরং দলীয় স্বার্থে, উপদলীয় স্বার্থে, এমনকি ব্যক্তিগত স্বার্থেও তাঁরা সন্তানতুল্য তরুণ-তরুণীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী সহিংসতায় লিপ্ত হতে মদদ জোগান, অপরাধবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ দেন। এ যেন এক সন্তানকে দিয়ে আরেক সন্তানকে হত্যা করার সংস্কৃতি। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে আরও বেশি হতাশ লাগে এ জন্য যে তাদের কাছে অসৎ, অপরাধপ্রবণ ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোকদের সমাদর বেড়েছে; দলগুলোতে অপেক্ষাকৃত সৎ, ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের স্থান অনেক সংকুচিত হয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলে অপরাধপ্রবণ নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য ও উপদলীয় খুনোখুনির ঘটনা এ কারণেই অনেক বেড়েছে। এমনকি, যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে রয়েছে, তাদের মধ্যেও দলাদলির কারণও একই।

তাই এসব রাজনৈতিক দলের কাছে আশা করা যায় না যে তারা তাদের অশুভ প্রভাববলয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মুক্তি দেবে।

তাহলে উপায় কী? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলপ্রয়োগ ও নিষ্ঠুরতা চর্চার ভয়ংকর অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে সত্যিকারের বিদ্যাপীঠে পরিণত করার কোনো পথ কি খোলা আছে? যদি থাকে তাহলে সেই পথে কে সাহস করে হাঁটা শুরু করবে? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। অবশ্য আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটসহ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসমাজের মধ্যে যে সাহসী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ লক্ষ করা গেল, তা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এখন কী করা প্রয়োজন। বুয়েটে ‘সাংগঠনিক রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার দাবির মর্মার্থ ছাত্রলীগের প্রদর্শিত অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসানের দাবি। এই দাবি পূরণের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু বদলে যাবে, এমনটা আশা করা হয়তো যায় না। কিন্তু এটা পরিষ্কার হয়েছে যে ছাত্ররাজনীতির নামে এই নিষ্ঠুর দুর্বৃত্তপনা প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এবং এটা ঘটেছে কোনো প্রথাগত রাজনৈতিক শক্তির জোরে নয়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ সাহসিকতার জোরে। এটাই সঠিক রাজনীতি; অপরাজনীতিকে উৎখাত করার জন্য শিক্ষার্থীসমাজের এই রাজনীতিই করতে হবে।

‘সাংগঠনিক রাজনীতি’ নামক অপরাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা নিষিদ্ধ করার এই পদক্ষেপ আসলে খুবই প্রাথমিক একটা ধাপ। শিক্ষার্থীদের আরও অনেক কিছু করতে হবে। প্রথমত এই ভাবনা মাথায় রাখতে হবে যে ব্যক্তি মানুষ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়; সে সমষ্টির অংশ, সবার ভালোমন্দের সঙ্গে ব্যক্তির ভালোমন্দ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ভালো ছাত্র হওয়া, পরীক্ষায় ভালো ফল করা, ভালো চাকরি পাওয়া—সবই খুব জরুরি কথা। কিন্তু শেষ কথা নয়। শেষ কথা হলো একা একা ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকতে হয় সবাইকে নিয়ে, সবার সঙ্গে। সবার ভালোর স্বার্থে এই সংঘবদ্ধতাই রাজনীতি। আবরার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে নৃশংস অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোই রাজনীতি। শিক্ষার্থীদের এমন অন্যায়বিরোধী রাজনীতিই চালু রাখতে হবে। এই রাজনীতি চালু রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলে হলে যে নির্যাতনের অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা চিরতরে উচ্ছেদ করে নির্ভয়, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পড়াশোনার পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য।

শিক্ষার্থীরা পাঠচক্র করবেন, জ্ঞানবিজ্ঞানের সর্বসাম্প্রতিক অগ্রগতির নানা দিক নিয়ে সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করবেন, ডিবেটিং ক্লাব করবেন, চলচ্চিত্র সংসদ করবেন, নাটক-সংগীত-চিত্রকলার চর্চা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসবের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে, শিক্ষকেরা অনুপ্রেরণা জোগাবেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে নানা বিষয়ে গবেষণা করবেন, জরিপ-সমীক্ষা ইত্যাদি করবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু ক্যারিয়ারিস্ট পেশাজীবী তৈরি করবে না; সমাজ, দেশ, পৃথিবী সম্পর্কে সচেতন মানুষ গড়ে তুলবে—শিক্ষার্থীদের রাজনীতি হবে এই লক্ষ্যাভিমুখী।

এসব কথা উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই পথ। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজেদেরই তা করতে হবে, শুধু তাঁরাই তা করতে পারবেন। তাঁদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে শিক্ষকদের। শিক্ষাজীবনকে আনন্দদায়ক ও অনুসন্ধিৎসাময় করে তোলার জন্য সামষ্টিক কল্যাণকামী ও পরার্থপর রাজনীতি প্রয়োজন। সেই রাজনীতির বীজ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য সুপ্ত রয়েছে। প্রয়োজন সেই রাজনীতিকে বিকশিত করা। শিক্ষার্থীরাই সেটা করতে পারবেন।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]