ডেঙ্গুর বিপদ থেকেই যাচ্ছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমছে, কিন্তু মৃত্যুর খবর আসছে রোজ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মোট ৮৯ হাজার ৩৪৭ জন; চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ৮৭ হাজার ৭১৩ জন। অর্থাৎ পরিসংখ্যান বলছে, মোট ৯৭ ভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। এই তথ্য নিঃসন্দেহে আমাদের চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যসেবা পেশায় নিয়োজিতদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। চিকিৎসাকর্মীরা দিন–রাত পরিশ্রম করেছেন। অন্যদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেরা আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গেছেন কেউ কেউ। তবে যেসব ডেঙ্গু রোগী সরকারি হাসপাতালে আসেনি, তাদের সবার হিসাব এখানে নেই। অনেকে বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়েছে। যারা হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে বাড়ি ফিরে গেছে, তাদেরও কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যাবে না। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দিয়ে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায় মাত্র। ধারণা নেওয়ার অন্য একটা পদ্ধতি আছে। মানুষকে জিজ্ঞাসা করে জানা। ঢাকা শহরে কি এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে, যাদের কোনো পরিচিত, জানাশোনা পরিবারের কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি? অথবা এমন কোনো অফিস, যাদের কোনো সহকর্মী বা তাদের পরিবারের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি? আক্রান্তের সংখ্যা যা–ই হোক, আতঙ্কের বাইরে কেউ ছিল না, কেউ নেই।

আতঙ্ক কি দূর হবে?

পঞ্জিকায় বর্ষা ঋতু বিদায় নিলেও বৃষ্টির অবসান ঘটেনি। শরতেও মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকাসহ নানা জনপদে বৃষ্টির জল আটকে জলাবদ্ধতাও অব্যাহত আছে। শুরু হয়েছিল সেই চৈত্রে, ২৫ বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভেজা আর দীর্ঘ বর্ষা, বিবিসির আবহাওয়াবিদদের ভাষায়, ‘মোস্ট ওয়েটেস্ট মনসুন’।

সম্পূর্ণ কার্তিক এখনো পড়ে আছে। কার্তিকের কাইত্যান (লাগাতার ঝড়–বৃষ্টি) না হলে শীতের আমেজ আসে না। সেটাকেই আমরা আজকাল বলি সাইক্লোন সিজন। অতএব ভেজা ভেজা স্যাঁতসেঁতে দিন যাচ্ছে না চট করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক সানিয়া তাহমিনা এক টিভি চ্যানেলে যথার্থই বলেছেন, (ডিবিসি, ২৬ সেপ্টেম্বর) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু হবে। আগে যে সময়ে শীতের প্রকোপ হতো, এখন আর সে সময়ে শীত পড়ে না। তাই যে তাপমাত্রা থাকে, তা ডেঙ্গুর জন্য উপযুক্ত। অর্থাৎ ডেঙ্গু থাকছে।

কিন্তু কী রূপে থাকবে ডেঙ্গু?

গত দুই বছরে ডেঙ্গু তার রূপ বদলিয়েছে কয়েকবার। এই বদলের সঙ্গে তাল রাখার জন্য চিকিৎসকদের পাল্টাতে হয় চিকিৎসা রীতি (ট্রিটমেন্ট প্রটোকল)। ডেঙ্গুর রূপান্তরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসা রীতি পদ্ধতিকে উপযুক্ত আর হালনাগাদ রাখার জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক অনুসরণ আর গবেষণা। এ কাজে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে পাশে পেলে ভালো, নইলে নিজেদেরই করতে হবে।

নানা ধরনের ডেঙ্গু ছাড়াও এডিস মশার মাধ্যমে আমরা চিকুনগুনিয়ার ভয়াবহতা দেখেছি। বয়স্ক মানুষের অনেককেই পঙ্গু করে দিয়েছিল সে অসুখ। ডেঙ্গুবাহী শহুরে এডিস ‘এডিস ইজিপটা’ আর পল্লির এডিস ‘এডিস অ্যালবোপিক্টাস’ দুটোই এ দেশে থাকলেও গত বছর পর্যন্ত শহুরে এডিসই আমাদের জ্বালিয়েছে। গ্রামের এডিসের (অ্যালবোপিক্টাস) কাছে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার বিষ ছিল না। এ বছর দুই মশায় হাতে হাত মিলিয়ে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ইজিপটা এখন একটু ক্ষান্ত দিলেও অ্যালবোপিক্টাসের অভিযান বহাল আছে।

চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর পর কী?

দুই প্রজাতির এডিসের লার্ভা আর ডিম ধ্বংস করা না গেলে এডিস তার নিত্যনতুন তৎপরতা চালিয়ে যাবে। নাইজেরিয়া–উগান্ডার পর ব্রাজিলকে এডিস পঙ্গু করে দিয়েছিল জিকা দিয়ে। জিকা এখন ভারতে পৌঁছে গেছে। নেপালও আছে বড় ধরনের ঝুঁকিতে। প্রথম দিকে জিকায় আক্রান্তদের লক্ষণগুলো (হালকা জ্বর, চোখে ব্যথা ও লালচে রং, মাথাব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা ও শরীরে র‍্যাশ) দেখে সাধারণভাবে একে খুব ভয়াবহ মনে করেনি অনেকে। পরে গবেষণায় এর ভয়াবহতা ধরা পড়ে। জিকায় আক্রান্ত হলে স্নায়ু বিকল হয়ে গিয়ে অস্থায়ী পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে। কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে গর্ভবতী নারী যদি এতে আক্রান্ত হন, তবে তাঁর শিশু মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত হতে পারে। এতে শিশুর মাথা ছোট হয়। ফলে তার মস্তিষ্ক সঠিক আকারের হয় না বা বিকাশটা ঠিকঠাক হয় না। এসব শিশুর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার অথবা দেরিতে শেখার (স্লো লার্নার) আশঙ্কা থাকে।

আমরা কি প্রস্তুত?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার প্রধান ড. সানিয়া তাহমিনা সঠিকভাবেই বলছেন, ‘...যদি আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে এর দ্বারা বহন করা কোনো অসুখই হবে না।’...আমাদের সব শক্তি মশা নির্মূলে নিয়োজিত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা কি তা পারব? পেরেছিলেন এক হাবীবুল্লাহ বাহার ১৯৫৪ সালে। তিনি এখন আকাশের তারা। তঁার রেখে যাওয়া কুরসিতে যাঁরা বসেন, তাঁদের হ্যাডম নিয়ে জনগণের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আশার কথা রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকার চারটি হাসপাতাল থেকে নিয়মিত রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। এসব নমুনা থেকে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকার অবস্থান পরীক্ষা হয়। এ ছাড়া মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত শিশুদের ওপর সার্ভেইল্যান্সের প্রস্তুতি চলছে। এটা জানা যাবে শিশুটি জিকায় আক্রান্ত হয়েছে কি না। নমুনা সংগ্রহের পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে সীমান্ত লাগোয়া কয়েকটি জেলাকে এর আওতায় আনা প্রয়োজন।

গত মাসে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জানিয়েছিলেন, জিকা ভাইরাস পরীক্ষা খুব সহজ আর সস্তা। তিনি নিপসম হিসেবে পরিচিত জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর মতে, আজকাল হাতমেশিনে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে যতটুকু সময় লাগে, রক্ত দিয়ে জিকা পরীক্ষায় সে রকমই মিনিটখানেক লাগে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যেভাবে এডিস ছড়িয়েছে, তাতে দেশের হাসপাতালগুলোতে এটি পরীক্ষার যন্ত্রপাতি এখনই আনা দরকার। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে একটা তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]