'একক নারী ট্রাস্ট' একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

প্রবীণ নারী। ফাইল ছবি
প্রবীণ নারী। ফাইল ছবি

প্রবীণদের নিয়ে কাজ করে বেশ কিছু সংগঠন। মূলত বয়সের কারণে যেন কেউ একেবারে একা হয়ে না পড়েন। যেন শেষ বয়সটা আনন্দে কাটিয়ে যেতে পারেন। এ জন্য বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। কিন্তু প্রবীণ নারীদের জন্য, বিশেষ করে ‘একক প্রবীণ নারী’দের জন্য যে একটু আলাদা যত্নের দরকার, সেটা আমরা কতজন ভাবি? সম্প্রতি ‘একক নারী ট্রাস্ট’ ([email protected]) নামে একটি সংগঠন কাজ শুরু করেছে। দুটি কারণে একে আমরা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হিসেবে দেখতে পারি। প্রথমত, একক নারীরা রয়েছেন আমাদের চারপাশে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তাঁদের নিজস্ব একটা সত্তা, জীবনযাপন, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনার বিষয়টি আমরা খেয়াল করি না। একজন একক নারী শুধু বয়সের কারণে যখন একা হয়ে পড়েন, অনেক সময় তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও থাকে না। তাই একক নারীদের প্রবীণ বয়সে স্বস্তি–শান্তির জন্য কিছু করার প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ। 

দ্বিতীয় কারণটি আরও ব্যতিক্রমী। কারণ, এই ট্রাস্ট শুধু প্রবীণ একক নারীদের জন্যই চিন্তা করছে না। উদ্যোগ নিচ্ছে শিশুদের জন্যও। যে সমাজে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা ও চর্চায় মৌলিক মূল্যবোধের ঘাটতি থাকে, তা আধুনিক, সভ্য সমাজ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। 

একক নারী ট্রাস্ট উন্নত চিন্তা ও সংস্কৃতির এক আদর্শ নতুন প্রজন্ম গড়ার উদ্যোগটিও নিয়েছে। এখানেই এই ট্রাস্টের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, আবার তাঁরা নিপীড়ন–নির্যাতনের মধ্যেও রয়েছেন। সমাজে ‘একক নারী’ সামাজিক–সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তুলনামূলকভাবে কঠিন জীবন যাপন করেন। জীবনের শেষ ভাগে পৌঁছে তা আরও কঠিনতর হয়। কেননা এ সময়ে ভালো পরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনায় বেঁচে থাকাটাই অগ্রগণ্য অথচ তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে একজন নারী সেই একক প্রবীণ নারীদের সহমর্মী হয়ে, সংহতি জানিয়ে উদ্যোগী হয়েছেন যথাসাধ্য কিছু করার। তিনি নিজেও একজন প্রবীণ নারী। দীর্ঘদিন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা ছিলেন। স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছেন। প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়সে তিনি ষাটোর্ধ্ব বয়সের একক নারীদের পাশে দাঁড়ানোর এক মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন। সংগঠনের নাম দিয়েছেন ‘একক নারী ট্রাস্ট’। তাঁর সংগঠনটি রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। সংগঠনের ধারণাপত্রে তিনি লিখেছেন: একক নারীর সংজ্ঞা হচ্ছে যাঁরা নিঃসন্তান, বিয়ে করেননি, অফিশিয়ালি তালাক হয়েছে, যাঁদের ‘স্বামী’ মারা গেছেন, কিংবা এককথায় যাঁরা স্বামী-সন্তানহীন। এমন একক প্রবীণ নারীদের স্বস্তি ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং সুবিধাদিসহ প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে ট্রাস্টের প্রথম উদ্দেশ্য। 

পাশাপাশি সেখানে আরও বলা হয়েছে: একক নারীদের প্রবীণকাল যত্ন ও আনন্দের মধ্যে মর্যাদার সঙ্গে কাটবে, এটা তাঁদের স্বাভাবিক অধিকার। ভবিষ্যতে ভালো থাকার ভিত্তি হচ্ছে বর্তমানের দূরদৃষ্টি এবং সেই মতো কর্মযোগ। নিজেদের ভালো থাকা নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হয়। শুধু তা–ই নয়। সুস্থ সমাজ গঠনে দরকার সুস্থ চিন্তাচেতনায় উজ্জীবিত সুশিক্ষিত এক নতুন প্রজন্ম। সেই লক্ষ্য থেকে তাঁদের সংগঠনের ধারণাপত্রে বলা হয়েছে: নারীর প্রতি সহিংসতা এবং সব ধরনের বৈষম্য (নারী-পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, ধনী-গরিব ইত্যাদি) থেকে মুক্ত একটি সাবলীল ও মানবিক সমাজ গঠনে শিশুদের সেভাবে গড়ে তোলার অন্য কোনো বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে যার যেটুকু সাধ্য কাজ করা প্রয়োজন। যাঁরা মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে আগ্রহী, তাঁদের কর্ম, উদ্যোগ, নিষ্ঠা এবং ঐক্য সমাজকে বদলে দিতে পারে। একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের ভিত্তি হিসেবে প্রাক্‌-স্কুলশিশুদের জন্য মৌল মূল্যবোধবিষয়ক (সমতা, সততা, অহিংসা, সহযোগিতা, শিষ্টাচার, দায়িত্ববোধ, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি) একটি অনুকরণীয় শিশু শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করা তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য। তিনি তাঁর ব্যক্তিক সাধ্যের মধ্যে যা সম্ভব, অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদসহ তাঁর সবটুকুই ট্রাস্টকে দিয়েছেন। এখন প্রয়োজন সার্বিকভাবে ট্রাস্টের শক্তি বৃদ্ধি এবং পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সমমনা মানুষের এগিয়ে আসা। 

কয়েক মাস আগে প্রবীণদের অধিকার নিয়ে প্রথম আলোর উদ্যোগে আমরা একটি গোলটেবিল বৈঠক করেছি। সহযোগিতায় ছিল হেল্প এইজ ইন্টারন্যাশনাল। এরপর আমার একটি লেখা এই উপসম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হলে সমাজের অনেক সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। কয়েকজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত উদ্যমী ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। প্রবীণদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে তাঁরাও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। এসব উদ্যোগ এটাই প্রমাণ করে, দেশে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাঁদের ভালো কাজের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। 

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক