মেরুদণ্ড দিবস ও মাথাব্যথা সমিতি

১৬ অক্টোবর ছিল বিশ্ব মেরুদণ্ড দিবস। এ নিয়ে ফেসবুকে রসিকতার অন্ত নেই। মোটের ওপর কথা ছিল এই আমরা কেন মেরুদণ্ড দিবস পালন করি না? কারণ, আমাদের মেরুদণ্ড নেই!

একজন বামন মানুষ একবার গেল গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের অফিসে। গিয়ে বলল, আমার মেরুদণ্ড সবচেয়ে ছোট। আমার নাম আপনাদের রেকর্ড বইয়ে প্রকাশ করুন।

তারপর কী হলো?

লোকটা বেরিয়ে এসে বলল, না, হলো না। অল্পের জন্য ট্রাম্পের কাছে হেরে গেছি!

কাল রাতে ঘুমাতে গিয়ে আমি বললাম, হে আল্লাহ, আমি কী এমন পাপ করেছি যে তুমি আমাকে মেরুদণ্ড দিয়েছ? আর কত ব্যথা পাওয়ার পর আমার পাপের শাস্তির কোটা পূরণ হবে!

আপনাদের যাঁদের পিঠব্যথা, কোমরব্যথা নেই, মেরুদণ্ড আছে কি নেই, তাঁরা পরীক্ষা করাতে পারেন। আমার আছে। ও আমি প্রতি পলে পলে বুঝি। বড় বেদনার মধ্য দিয়ে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি।

তবে মেরুদণ্ড আছে কি নেই, সে পরীক্ষা বেদনা না পেয়েও করা যায়। মেরুদণ্ড শেষ হয়েছে লেজের আগে আগে। পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, লেজের পরে মেরুদণ্ডের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় কি যায় না।

রসিকতা করছিলাম। তবে মেরুদণ্ড দিবস রসিকতা করার জন্য নয়। এটা গুরুতর একটা বিষয়। সারা পৃথিবীর ১০০ কোটি লোক পিঠে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, কোমরের ব্যথায় ভোগে। পৃথিবীতে যত লোক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, তাদের চারজনের একজনের আছে মেরুদণ্ডের সমস্যা।

আবার ব্যথায় ভুগতে ভুগতে ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে লিভার কিংবা কিডনির অসুখ বাধাই আমরা।

ব্যায়াম, ওজন, লাইফস্টাইল এগুলো ঠিকঠাক করা বা রাখার মাধ্যমে মেরুদণ্ডের সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়। ফিজিওথেরাপিস্ট, কায়রোপ্রাক্টরদের চর্যার মাধ্যমে ব্যথানাশক না খেয়ে বা অস্ত্রোপচার না করেও সুস্থ থাকা সম্ভব। এই হলো বিশ্ব মেরুদণ্ড দিবসের তাৎপর্য।
তবে মেরুদণ্ড নিয়ে আমাদের অনেক চিন্তা। আমরা কথায় কথায় বলি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড!

এর মাধ্যমে আমরা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝব, নিশ্চয় এটাই ছিল এই প্রবাদ রচয়িতাদের অভিপ্রায়। আমরা মেরুদণ্ডকে আদৌ প্রয়োজন মনে করি না। বরং মেরুদণ্ড ছাড়া চলতে পারলে জীবনে আয়-উন্নতি করা যায়। যেখানে যখন খুশি নত হওয়া যায়। কেঁচোর মতো মাটির সঙ্গে মিশে থাকা যায়। তেমনি শিক্ষা ছাড়াও আমাদের বেশ চলে। যার শিক্ষা ও মেরুদণ্ড নেই, এই দেশে তার উন্নতি ঠেকায় কে?

শিক্ষার কথা যখন এলই, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথাও আসবে। আমাদের দেশে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের সময় একটা জিনিস আছে কি না, খোঁজ নেওয়া হয়—মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড থাকা মানে শিক্ষা থাকাও। শিক্ষা থাকা মানে মেরুদণ্ড থাকাও। আপনাদের জন্য কুইজ: মেরুদণ্ড থাকলে ভিসি হওয়া যায়, নাকি না থাকলে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়। কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে ঠিক ফরমাশ-দেওয়া জিনিসটা পাওয়া যায়—এক কলের সঙ্গে আর-এক কলের উৎপন্ন সামগ্রীর বড়ো-একটা তফাত থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়। কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের অনেক তফাত।

এমন-কি, একই মানুষের একদিনের সঙ্গে আর-একদিনের ইতর-বিশেষ ঘটে। তবু মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায় কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না। কল সম্মুখে উপস্থিত করে কিন্তু দান করে না। তাহা তেল দিতে পারে কিন্তু আলো জ্বালাইবার সাধ্য তাহার নাই।’

বুয়েট প্রসঙ্গে আমার এই রকমটাই ধারণা। এটা একটা কল মাত্র। আমরা যেদিন প্রথম ক্লাস করতে যাই, সেদিন আমাদের একটা হলঘরে সমবেত করে এক স্যার গৌরবের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ওয়েলকাম টু বি ইউ ই টি। তোমরা হলে ক্রিম অব দ্য ক্রিম। আমরা ছেঁকে ছেঁকে তোমাদের এনেছি।’

তো সবচেয়ে ভালো কাঁচামাল এনে চার বছর ধরে ছাঁচে ফেলে আমাদের বিস্কুটের মতো বা সাবানের মতো বা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো করে বের করা হয়। মেইড বাই বুয়েট।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কথাটা মিথ্যা নয়। মানুষ তো কল নয়। দম দেওয়া পুতুল নয়।

তো তার ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে, এটা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। যদি আমাদের আদৌ হাড় থেকে থাকে!

নাহ্। গদ্যকার্টুন সিরিয়াস হয়ে গেলে সেটা আর গদ্যকার্টুন থাকে না। আরও একটি মেরুদণ্ড কৌতুক কি বলে নেব?

জাপানি বলল, আমরা একজন সদ্য মৃত মানুষের হৃৎপিণ্ড আরেকজন মানুষের বুকে বসিয়েছি, এক মাস পরে দ্বিতীয়জন কাজে যোগ দিয়েছে।

জার্মান বলল, আমরা একটা মৃত মানুষের ব্রেইন একজন রোগীর মাথায় বসিয়েছি, দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগী হেঁটে বাড়ি গেছে।

ব্রিটিশ বলল, আমরা একজন মৃত ব্যক্তির মেরুদণ্ড একজন রোগীর শরীরে বসিয়েছি, এক সপ্তাহ পর রোগী অলিম্পিক দৌড়ে অংশ নিয়েছে।

আমেরিকান বলল, আমরা একজন মানুষ পেয়েছি, যার হৃৎপিণ্ড নাই, মেরুদণ্ড নাই, মগজ নাই, কয়েক মাসের মধ্যে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন।

আচ্ছা, মেরুদণ্ড দিবস নিয়ে এত কথা হচ্ছে, আপনারা কি জানেন, ২২ জুলাই ছিল ওয়ার্ল্ড ব্রেইন ডে। বিশ্ব মগজ দিবস। আমরা তো সেটাও পালন করিনি। বিশ্ব মগজ দিবস পালন করে মাথাব্যথা সমিতি। হেডেক সোসাইটি। আশ্চর্য হচ্ছেন কেন, ডায়াবেটিক সমিতি থাকলে, থ্যালাসেমিয়া সমিতি থাকলে মাথাব্যথা সমিতিও থাকতে পারে। পারে না, পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে।

বাংলাদেশে অবশ্য মাথাব্যথা সমিতি নেই।

এই নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাও নেই।

থাকবে কোত্থেকে? জামাহীন লোকের পকেট আসবে কোত্থেকে?

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক