কয়েক লাখ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। পাশে বিএমডিসির সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। পাশে বিএমডিসির সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা। ছবি: প্রথম আলো

দেশে বছরে ৫ লাখ ৭১ হাজারের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। বছর বছর শিশুজন্মে অস্ত্রোপচারের ব্যবহার বাড়ছে। ক্ষতিকর এই প্রবণতা রুখতে আইন প্রণয়নসহ সরকারি, বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী ও এনজিও প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো ‘স্বাভাবিক প্রসবে উদ্বুদ্ধকরণ ও অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। আয়োজনে সহায়তা দেয় আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক অনেক গভীর উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের সঙ্গে সংগতি রেখে সরকার বেশ কয়েকটি কার্যপরিকল্পনা (অপারেশন প্ল্যান) তৈরি করেছে। এসব পরিকল্পনায় স্বাভাবিক প্রসব বাড়ানোর পন্থার কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিতভাবে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, অস্ত্রোপচারে প্রসবের বিরূপ প্রভাব পড়ে নবজাতকের ওপর। বিএমডিসি আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত হলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে বিএমডিসি।

শিশুজন্মে অস্ত্রোপচারের ভূমিকা ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক মান্নান। তিনি বলেন, দেশে বছরে ১০ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে ৫ লাখ ৭১ হাজারের বেশি প্রসবে অস্ত্রোপচারের কোনো প্রয়োজন হয় না। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বড় অংশটি হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। এসব অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের কারণে মানুষের পকেট থেকে বছরে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি বের হয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে একাধিক আলোচক বলেন, গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। প্রসবে অস্ত্রোপচার একটি জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। তবে স্বাভাবিক প্রসবই মা ও নবজাতকের জন্য মঙ্গলজনক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ, নবজাতক, শিশু ও কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য কর্মসূচির বিষয়ভিত্তিক পরিচালক মো. শামসুল হক বলেন, এখনো প্রায় অর্ধেক শিশুর জন্ম হচ্ছে বাড়িতে। অন্যদিকে ৫৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যু হচ্ছে রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনিতে। সরকার ৪২৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতিসেবা, ১৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সব জেলা হাসপাতাল ও সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সমন্বিত জরুরি প্রসূতিসেবা চালু করেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মনজুর হোসেন বলেন, সেবা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা তৈরির জন্য সবাইকে যত্নবান হতে হবে।

বাংলাদেশে প্রায় অর্ধেক মায়ের মৃত্যু হচ্ছে গ্রামে, এই তথ্য দিয়ে মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচির কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. মোশায়ের-উল-ইসলাম বলেন, মুক্তাগাছা, ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্বাভাবিক প্রসব বেশি হচ্ছে। এদের অভিজ্ঞতার বিস্তার হওয়া দরকার।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, স্বাভাবিক প্রসব মা ও নবজাতকের জন্য কল্যাণকর। এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

প্রসূতির সম্মান, প্রসবে গোপনীয়তা—এসবের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য দেন মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রওশনারা বেগম। তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজগুলোতে সবচেয়ে খারাপ জায়গা লেবার রুম। বেসরকারি অনেক ক্লিনিকে লেবার রুম নেই, কিন্তু অস্ত্রোপচার হচ্ছে। তিনি বলেন, সব লেবার রুম সেবার উপযোগী করে তুলতে সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) মহাসচিব সালেহা বেগম চৌধুরী বলেন, যে মায়ের অস্ত্রোপচার দরকার, তাঁর জন্য সেবাটি নিশ্চিত করা জরুরি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশনা ইমাম বলেন, বিদ্যমান দুটি আইনে সাধারণ বিষয় বলা আছে। অস্ত্রোপচার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। তাঁর করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাতে বলা ছিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিএমডিসি একটি নীতিমালা তৈরি করে আদালতে পেশ করবে। সেই নীতিমালা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিধিমালা তৈরি হবে। আগামী ডিসেম্বরে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিমালা জমা দেওয়ার কথা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান শামস এল আরেফিন বলেন, এমন ধারণাও কিছু মানুষের মধ্যে আছে যে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম দেওয়াই হচ্ছে স্বাভাবিক ঘটনা।

দক্ষ মিডওয়াইফ সন্তান প্রসবে একজন চিকিৎসকের চেয়েও ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, রোগনির্ণয়কেন্দ্র মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান। তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের দায় এককভাবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক-মালিকদের ওপর চাপানো ঠিক হবে না।

নারী ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক খুরশিদ তালুকদার নিজেদের প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমিয়ে আনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ২০১৬ সালে ওই হাসপাতালে ৬৫ শতাংশ প্রসব হয়েছিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। ২০১৮ সালে ৪০ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছিল অস্ত্রোপচারে।

স্বাভাবিক প্রসবে মিডওয়াইফদের বিশেষ ভূমিকার বর্ণনা দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডওয়াইফারি শিক্ষা কার্যক্রমের প্রকল্প পরিচালক সেলিনা আমিন। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) স্বাস্থ্য খাত বিশেষজ্ঞ দেওয়ার মো. ইমদাদুল হক বলেন, চিকিৎসকদের স্বাভাবিক প্রসবের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচির পরিচালক শামীম জাহান বলেন, স্বাভাবিক প্রসব বাড়াতে যে খসড়া প্রকল্প দলিল তৈরি করা হয়েছে, তা দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনবলের সহায়তা দিতে পারবে তাঁর প্রতিষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।