তবুও কি ক্যাম্পাসে শান্তি আসবে?

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা পার করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভেঙে পড়া অবস্থা একদিনে যে তৈরি হয়নি, সেটি আমরা সবাই জানি। বিশ্ববিদ্যালয় বলে এখন আর কিছু নেই কোথাও। শুধু দালানকোঠা, সেই দালানকোঠায় এপাশ-ওপাশ করছেন শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা। আর বাইরে যেটি, তা হলো অধিকারহীনতা, অসম্মান, প্রতি পদে পদে নিগৃহীত হওয়ার ঝুঁকি। আর যখনই এগুলোতে বড়সড় ঝাঁকুনি লাগে, তখনই সবার নাক ছাত্ররাজনীতির গন্ধ শুঁকতে থাকে। মনে হয় সব নষ্টের গোড়া ওই ছাত্ররাজনীতি।

আমরা ধরেই নিচ্ছি, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। এখন তাহলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হাজির করছি। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে শিক্ষার্থীদের সবাই কি আবাসিক হলগুলোতে সিট পাবেন? তাঁরা কি কোনো ধরনের নিপীড়নের শিকার হবেন না? বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়রদের মাধ্যমে জুনিয়রদের ওপর র‍্যাগ দেওয়ার যে সংস্কৃতি জারি আছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল এবং খোদ কর্তৃপক্ষের সামনেই, সেগুলো কি তাঁরা কঠোরভাবে দমাতে পারবেন? আমরা জানি, প্রতিবছরই র‍্যাগিংয়ের কারণে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেত বাধ্য হন। গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ছেলেটি চলে গেছেন, প্রশাসন কি সেটির বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছিল? যেখানে সাম্প্রতিক সময়েই একজন ছাত্র মারা যাওয়ার পর খোদ বুয়েট উপাচার্য ঘটনাস্থলে আসতে কয়েক ঘণ্টা দেরি করেন এবং এই দেরির ব্যাখ্যা হিসেবে কোনো ধরনের অপরাধবোধকে হাজির না করে অবলীলায় সামনে নিয়ে আসেন ‘ওপরের মহলে’র সঙ্গে কথা বলার বিষয়টিকে। তখন ছাত্ররাজনীতিকে কীভাবে দুষবেন?

অথচ উপাচার্যের খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কষ্টে, আতঙ্কে, সন্তান হারানোর বেদনায় নুয়ে যাওয়ার কথা। তাঁর দৌড়ে ছুটে আসার কথা। শিক্ষার্থীর মৃত্যুর চেয়ে একজন শিক্ষকের কাছে কষ্টের কিছু হতে পারে না। আবরারের বাবা আর শিক্ষকদের একই ব্যথায় পরস্পরকে চিনে নেওয়ার কথা। কিন্তু সেই অনুভূতিগুলো বর্তমানে বিকিয়ে গেছে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায়। তাই তিনি আসতে পারেন না, আসতে চান না। ক্ষমতার জাল ছিন্ন করে তিনি বুক পেতে নিতে পারেন না প্রিয় ছাত্রের মরদেহকে। বলতে পারেন না, ‘এ লাশ আমি রাখব কোথায়?’ হ্যাঁ, ক্ষমতার সেবক শিক্ষকদের এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের এই ফাউস্টীয় চরিত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচারহীনতার জন্য দায়ী।

এই ক্ষমতাবাদিতায় আমরা ক্রমেই বোধের আলো নিভিয়ে ফেলছি। আর তাই আমরা শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডের রং চিনি না। আমরা নৈতিকভাবে পরাজিত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সামনে গিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি না, ছাত্ররাজনীতি করলে কেন একজনকে মেরে ফেলতে হবে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য? আমরা বলতে পারি না, আমার শিক্ষার্থী খুন করবে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমরা বলতে পারি না, তারা কেন বিরোধীপক্ষের প্রতি এত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে?

কেননা মূল রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আমরা এই শিক্ষাই গ্রহণ করছি, যেখানে বিরোধী দল কিংবা ভিন্নমতকে দমনই রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকনেতারা কী বলতে পারবেন, শিক্ষকরাজনীতিতে ভিন্নমতকে আপনারা সম্মান দিয়েছেন। এখন সবাই জানে, কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয় না। অন্যের মতামতের গুরুত্ব না দিলেও, সবকিছু জিতে না হলেও সব দখলে নেওয়া যায়। যে কারণে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষক হিসেবে তাঁরা সামনে দাঁড়াতে পারেন না।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আস্থা-ভালোবাসা আর সম্মানের সম্পর্ক। কিন্তু সেই শিক্ষক যখন যৌন নিপীড়ক হন, যখন তাঁর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অনৈতিকতার অভিযোগ ওঠে। যখন তিনি শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর শুনেও ‘ওপর মহলের নির্দেশনা’র জন্য অপেক্ষা করেন, তখন আসলে ছাত্ররাজনীতির বিষয়টি অনেক দূরের হয়ে ওঠে। এই আস্থাহীনতার সম্পর্কই শিক্ষাঙ্গনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বেশি। তাই প্রধান সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করেই এগোতে হবে। অযথা শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের অধিকারটুকুও ছিনতাই করে অরাজনৈতিক মানুষ হিসেবে তৈরি করার আরেক কারখানা খোলা হবে সত্যিই আত্মঘাতী।

এখন ছাত্ররাজনীতির মূল জায়গা নিয়ে তর্ক পাড়ি, তাহলে কী দেখব? বাংলাদেশে খোদ ৯০ সাল পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতি ছিল রাষ্ট্র এবং সরকারের কর্তৃত্ববাদী চেহারার বিপক্ষে দাঁড়ানোর, যার মূল লক্ষ্যই ছিল এস্টাবলিশমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করা। কিন্তু ৯০-এ এসে দেশ গণতান্ত্রিক পরিবেশের অঙ্গীকার করলেও ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে এটি বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনেকটাই ছিল অনৈতিহাসিক। যেখানে মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাসে হল দখল, আধিপত্য বিস্তার, বিরোধী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দমন-নিপীড়ন, হল থেকে বের করে দেওয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির পাশাপাশি খুন, মারামারি, গোলাগুলি, টর্চার সেল তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ভয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

ছাত্রজীবনের সবচেয়ে সৌকর্যের জায়গা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ শাণিত হওয়ার বোধ তৈরি করা, সেখান থেকে কেন ছিটকে ফেলা হবে শিক্ষার্থীদের? যদি বন্ধ করতেই হয়, তাহলে বন্ধ করা দরকার খুনি, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে, যাদের উদ্দেশ্য শিক্ষা কিংবা শিক্ষার্থীর অধিকার নিয়ে কথা বলা নয়, খুন, সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার চর্চাকে জিইয়ে রাখা। তাই একজন শিক্ষক হিসেবে এসব দায় এবং দায়িত্ব পালন করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়েই বলছি, মানুষ হিসেবে কি আমরা অনৈতিহাসিকাতর ওপরই ভর করে দাঁড়িয়ে আছি? আমাদের আচরণ, ইচ্ছা, রাজনৈতিক, মতাদর্শিক জায়গা সবই কেমন যেন অনৈতিহাসিক হয়ে উঠছে দিনদিন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মানবিক মানুষ গড়ার কারখানা হিসেবেই দেখতে চাই।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]