ক্যাসিনোর নেশা কীভাবে কাটাবেন

ক্যাসিনো ।  প্রতীকী ছবি
ক্যাসিনো । প্রতীকী ছবি

ক্যাসিনো নিয়ে সম্প্রতি অনেক কথা হচ্ছে। মানুষের কয়েকটি নেশাকে আদিম নেশা হিসেবে ধরা হয়। তার মধ্যে নেশাদ্রব্য, সুরা ও জুয়া অন্যতম। ক্যাসিনোতে এখন যে কেউ ঘুরতে যেতে পারেন। সেখানে ভালো খাবার অল্প দামে দেওয়া হয়, সে জন্য যেতে পারেন। লাস ভেগাসে ক্যাসিনোর ভেতরে বড় বড় শো চলছে, জাদু দেখাচ্ছে, সেগুলো দেখতেও যে কেউ যেতে পারেন বা যাচ্ছেন। কিন্তু নেশার খপ্পরে একবার পড়ে গেলে সেই নেশা ড্রাগের থেকে কিছু অংশে কম ক্ষতিকর নয়।

নেশার কারণে যখন স্বাভাবিক জীবন বিঘ্নিত হয়, তখন তাকে বলতে হবে নেশার সংকট। এই দ্বিতীয় পর্যায়টি জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলে। একজন নেশার কারণে পড়াশোনা করছেন না অথবা তিনি যদি চাকরিজীবী হন, তাহলে অফিসে ঠিকমতো যেতে পারছেন না; তখন তাঁর জীবনযাত্রা আর স্বাভাবিক থাকে না। তখনই সাহায্যের প্রয়োজন হয়। মা–বাবা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন, আত্মীয়স্বজনেরা এগিয়ে আসেন, উদ্বিগ্ন হয়ে ভালো বন্ধুরাও ছুটে আসেন; কিন্তু নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি কারও সাহায্য নেন না। তিনি সব কিছু গোপন করা শুরু করেন। যাঁরা এসব বন্ধের জন্য তাঁর কাছে আসেন, তাঁদের তিনি এড়িয়ে যান।

কম্পিউটার সিস্টেমের দুর্বলতার কারণে যেমন তাকে হ্যাক করে হ্যাকার নিজের ইচ্ছামতো চালাতে পারে, নেশাও তেমনিভাবে মানুষের মাথাকে হ্যাক করে তার মতো করে চালাতে পারে। মানুষের সুস্থ ভাবনা, সেই নেশার ক্ষতি বোঝার বা সেটাকে বাদ দেওয়ার ইচ্ছাটুকুও সে ‘হ্যাক’ করে নেয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রেইনে একটা প্যাটার্ন তৈরি হয় যায়। সেই সুখটাকে নেওয়ার জন্য মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে পড়ে। এর শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটা প্রায় সম্পূর্ণই উদ্‌ঘাটন হয়ে গেছে। মূলে রয়েছে ডেল্টা ফসবি (FosB) নামে জিনের ভেতরের একটি প্রোটিন। ডেল্টা ফসবি মাথার ভেতরে নেশার কাজ শুরু করায়। নেশার ধর্ম হচ্ছে, যতই তাকে করা যায়, ততই সে শক্তিশালী হয়।

ক্যাসিনো বা অন্য ধরনের জুয়া কখনোই উপার্জন হতে পারে না। যিনি খেলেন, হারলে পরে তিনি খেলেন হারানো টাকাগুলো উদ্ধার করার জন্য, জিতলে খেলেন আরও বড় দান জেতার জন্য। সেখানেই তাঁর নেশা হয়ে যায়। আর জেতার পর কেউ সেই খেলা বন্ধ রাখতে পারেন না। আবার খেলেন, জিতেন-হারেন-জিতেন; আবার খেলেন, অবশেষে হারেন। এ নিয়ে অনেক গবেষণা আছে, অনেক বই আছে। যেমন ‘দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট’ নামে চার্লস ডুহিগের (The Power of Habit-Charles Duhigg) নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বই রয়েছে, যেটা বাংলায় অনুবাদও হয়েছে।

ক্যাসিনোতে হারাটা অবশ্যম্ভাবী। কারণ, জিতলেও তিনি আবার যাবেন। নেশায় আসক্ত জুয়াড়ি একমাত্র তখন খেলা বন্ধ করবেন, যখন তাঁর আর কোনো টাকা নেই, লোন নেওয়ার কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই, বিক্রি করতে পারেন, এমন কিছুও নেই। তত দিনে তিনি চাকরি, বিবাহিত হলে তাঁর জীবনসঙ্গী—সব হারাবেন। এ অবস্থায় অনেকে আত্মহত্যা করেন।

মূলত খেলার মধ্যে যে একটা উত্তেজনা আছে, জেতার মধ্যে যে একটা ভীষণ আনন্দ এবং অর্জনের অভিজ্ঞতা আছে, সেটা মস্তিষ্ক বারবার পেতে চায়। ভিডিও গেমে আসক্তির মতোই, তবে আরও তীব্র। অর্থ উপার্জন এখানে মুখ্য নয়। যেমন সেই একই পরিমাণ অর্থ কেউ তাঁকে দিয়ে দিলেও তিনি ক্যাসিনোতে বা তাসের আড্ডায় খেলে সেটা জিততেই পছন্দ করবেন। বাজার থেকে মাছ কেনা আর বড়শি দিয়ে ধরার তফাতের মতো। কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবেই অর্থের ব্যাপারটা চলে আসে। তারপর অর্থের অভাবের কারণে একজন মানুষ সব হারাতে থাকেন।

আরেকটা ব্যাপার হয়তো সহজে চোখে পড়ে না। সময়। সময়টাই মানুষের জীবনের প্রধান সম্পদ। ক্যাসিনোতে বা অন্য কোনো জুয়ার আড্ডায় গেলে, সেই মহামূল্যবান সময়টাই চলে যাচ্ছে। ধরা যাক একজন বললেন, আজ ক্যাসিনোতে তাঁর ১০০ ডলার হার হয়েছে। সেটা ভুল ধারণা। দেখা যাবে তিনি হয়তো ১৬ ঘণ্টা খেলেছেন। এই ১৬ ঘণ্টায় একেবারে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করলেও তিনি ১৬০ ডলার পেতেন। অথবা ছাত্র হলে এই সময় তিনি পড়াশোনা করতে পারতেন, সেখানে ক্ষতি হচ্ছে। পিতা হলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারতেন, বন্ধুদের সঙ্গে খোশগল্প করতে পারতেন। বাড়ির পেছনে বাগান করতে পারতেন। সেগুলোর কোনোটাই হচ্ছে না। হবেও না। এই সব ক্ষতি অপূরণীয়।

যখন একজন তাঁর পকেটের শেষ কপর্দক দিয়েও খেলবেন, তখন তাঁকে বলা হয় ‘প্রব্লেম গেম্বলার’। একটি টাকাও তিনি বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবেন না। এই পর্যায়ে তিনি আত্মীয়, বন্ধুদের কাছে মিথ্যা বলতে শুরু করেন। লোন নেওয়া, জিনিসপত্র বিক্রি করা শুরু করেন।

প্রথম অংশে ক্ষতিকে বুঝতে শিখুন। সময়ের অপূরণীয় ক্ষতিটাকে দুই মিনিট সময় দিয়ে খতিয়ে দেখুন। দ্বিতীয় অংশে সব ভুল ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। আরেকবার গেলেই হয়তো ভাগ্যের শিকেটা ছিঁড়বে, এই ধারণাই সব গন্ডগোলের মূল। এমনকি বড় জ্যাকপট পেলেও সবকিছু ঠিক হবে না। পাওয়া না–পাওয়াটা কারণ নয়, মস্তিষ্ক ‘হ্যাক’ হয়ে গেছে। ‘ডেল্টা ফসবি’ মাথার ভেতর থেকে সাক্ষাৎ শয়তানের মতো ধাক্কা মারছে, ‘যা, আজকে তোর জিত হবে।’

গবেষকেরা বিভিন্ন সমাধান দিয়েছেন। একটা খাতায় প্রতিবার ক্যাসিনো বা অন্য কোথাও খেলায় যে লাভ বা ক্ষতি হয়, সেটা লিখে রাখলে দেখবেন কদিন পরেই সব পরিষ্কার হয় আসছে। মানুষের আসক্ত মন নিজেকেই ভুলিয়ে রাখে। সে জেতার বিপুল আনন্দটা দীর্ঘদিন মনে রাখায়, বারবার কুমিরের বাচ্চার মতো দেখায়। হেরে যাওয়ার গ্লানি আর বেদনটাকে হয় মুছে ফেলে অথবা দুয়েকবার ঘটেছে মাত্র এভাবে অনেক ছোট করে দেখায়। কাজেই, লিখে রাখলেই সব সত্য বেরিয়ে আসবে।

আরেকটি খুবই কাজের ব্যবস্থা আছে। সেটা হলো, নিজেকে নিজেই ক্যাসিনো থেকে বহিষ্কার করা। একে বলে ‘সেলফ এক্সক্লুশন’। সব ক্যাসিনোতে সেই ব্যবস্থা আছে। যেকোনো নেশার ক্ষেত্রেই, শুধু নিজের নিয়ন্ত্রণের ওপরে ছেড়ে না দিয়ে এমন কিছু করতে হয়, যেন নেশা করার কোনো উপায় আর না থাকে। ‘এক্সক্লুশন’ এ জন্যই খুব কাজের।

এটাকে ছাড়ানোর সর্বশেষ ব্যবস্থা হলো ‘রিহ্যাব’–এ ভর্তি হওয়া। অনেক দিন বিষয়টা থেকে দূরে থাকলে, মস্তিষ্কে যে প্যাটার্ন তৈরি হয়েছিল, সেই প্যাটার্ন মুছে যায়। আপনি জঙ্গলে প্রতিদিন একই দিকে হেঁটে হেঁটে পথ তৈরি করেছেন। কিছুদিন না হাঁটলে সেই পথ গাছপালায় ঢেকে যাবে। কিছু ওষুধেও সাময়িক কাজ হবে। রিহ্যাবে তারা সেগুলো প্রেসক্রাইব করতে পারে। হটলাইন, সাপোর্ট গ্রুপ সেগুলোও যেকোনো নেশা থেকে মুক্তির জন্য খুব কাজে দেয়।

ক্যাসিনো যতই ঝকঝকে হোক না কেন, যতই সাদরে আহ্বান করুক না কেন, মনে রাখবেন, আপনার টাকা এবং মূল্যবান সময় রেখে দেওয়ার সেটা একটি বড় ফাঁদ। এর চেয়ে বরং ক্যাসিনোতে চাকরি নিন। চাকরি নিলে সেখানে খেলার আর উপায় থাকে না, আবার উপার্জনও হচ্ছে। অথবা ক্যাসিনো যেই কোম্পানির, সেই কোম্পানির শেয়ার কিনুন। তারা তো ফুলে ফেঁপে উঠবেই, তার মানে শেয়ার দামও বাড়বে। এ দুটো কোনো সিরিয়াস পরামর্শ না, পরিহাস করে বলা।

এই সুন্দর সম্ভাবনাময় জীবনকে নেশার হাতে ছেড়ে দেওয়ার মতো বোকামি আর নেই। নেশা একটি রোগ। নিজের ক্ষতি, সমাজের ক্ষতি। একটি ভালো বই পড়ুন, ভালো মুভি দেখুন। সমুদ্রস্নানে যান। হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসুন। গরিদের মধ্যে খাবার বিলান। বাচ্চাদের সময় দিন। দেখবেন, পৃথিবীর অনাবিল আনন্দ জীবনকে কত উজ্জ্বল, কত উজ্জীবিত করে তুলতে পারে। আর সেটা থেকে নিজেই কিনা নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন!

না, ভুল হলো। বলা উচিত ‘ডেল্টা ফসবি’কে দানব বানিয়ে জীবনটা তার বদ ইচ্ছার হাতে নিজেই তুলে দিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছেন।

মোস্তফা তানিম: প্রকৌশলী ও লেখক।