স্বাভাবিক প্রসবের শিশুরা বেশি স্মার্ট

শিশু জন্মের সময় জটিলতা দেখা দিলে অপারেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসবের বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়। এটাই সিজারিয়ান বা সি-সেকশন। কথিত আছে, রোমের সম্রাট জুলিয়াস সিজারের জন্ম হয়েছিল অপারেশনের মাধ্যমে, সেখান থেকেই নামটা এসেছে। অবশ্য এটা কতটা সত্য, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রসবের সময় কিছু জটিলতায় মা ও নবজাতকের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। তখন সিজারিয়ান অপরিহার্য। কিন্তু এতে মা ও শিশুর কিছু সমস্যাও হয়। তাই একেবারে অপরিহার্য না হলে যেন সিজার না করা হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

সিজারিয়ান শিশু বা অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের চেয়ে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া শিশুরা বেশি স্মার্ট। প্রশ্ন ওঠে, জন্ম অপারেশনে না স্বাভাবিক প্রসবে হলো, তার সঙ্গে স্মার্ট কমবেশি হওয়ার সম্পর্ক কী? সম্পর্ক একটা আছে, সে কথায় পরে আসছি।

তার আগে দেখা যাক, শিশু জন্মের অবস্থাটা কী। এই জরুরি বিষয়ে গত সপ্তাহে প্রথম আলোর উদ্যোগে একটি গোলটেবিল বৈঠক হয়। সহযোগিতায় ছিল সেভ দ্য চিলড্রেন। তাদের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক মান্নান তাঁর মূল বক্তব্যে বললেন, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান বা অপারেশনের মাধ্যমে শিশু জন্মের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এর ফলে মা ও শিশু দুজনেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তাই আলোচনায় সবাই বললেন, অপ্রয়োজনে অপারেশনের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার কমিয়ে আনতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, এই হার মোট শিশুজন্মের ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে ৩১ শতাংশ শিশু জন্ম নেয় অপারেশনের মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ছিল প্রায় ২১ শতাংশ। মাত্র এক বছরেই ৫০ শতাংশ বেড়ে গেল। খুব বেশি। এই হার কমিয়ে আনতে হবে। একটা অভিযোগ আছে যে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক অপ্রয়োজনীয় অপারেশন করে। এতে তাদের লাভ বেশি। অবশ্য অনেক হাসপাতালের ডাক্তাররা একেবারে বাধ্য না হলে অপারেশনে যান না। অন্যদিকে এটাও সত্য যে অনেক মা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চান না যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রসূতি মায়ের ব্যথা-বেদনায় খুব বেশি কষ্ট হোক। তার চেয়ে অপারেশনই ভালো।

কিন্তু অনেকেই ভেবে দেখেন না অপারেশনের চেয়ে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া শিশু অনেক বেশি ভালো থাকে। সম্প্রতি মেলবোর্নে এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া শিশুরা অনেক বেশি স্মার্ট এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তাদের অনেক বেশি। জন্মের পরপরই ওরা সহজে ও দ্রুত মায়ের বুকের দুধ পায় ও খেতে পারে। জন্মের পরপরই মায়ের ত্বকের স্পর্শে এসে নবজাতক প্রয়োজনীয় উষ্ণতা পায়। এসবই সম্ভব হয় স্বাভাবিক জন্মের কারণে। জন্মনালি অতিক্রমের সময় নবজাতকেরা কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া পায়। এগুলো তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।

স্বাভাবিক জন্মের শিশুরা যে শুধু স্মার্ট হয়, তা-ই নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই শিশুরা পরবর্তী জীবনে অনেক বেশি মেধার পরিচয় দেয়। পড়াশোনায় ওরা ভালো করে। এই খবরগুলো আমাদের অনেকেই জানি না।

অনেকে মনে করে, স্বাভাবিক প্রসবে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি। সেটা কিছু জটিল ক্ষেত্রে খাটে। অনেক সময় সিজার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেটা তো মানতেই হবে। কিন্তু দেখা গেছে, অপ্রয়োজনীয় সিজারের সংখ্যাই বেশি এবং এতে হুমকি বাড়ে। অপারেশনের পর মায়ের অনেক ভোগান্তি হয়। শিশুরাও নানা অসুখ-বিসুখে ভোগে।

আসল কথা হলো, আমাদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক সময় স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিষ্কার প্রসবকক্ষ থাকে না। বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে। আবার জরুরি প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে অপারেশনের দরকার হলে তার জন্য বিকল্প প্রস্তুতি কতটা থাকে, সেটাও প্রশ্ন। তাই খরচ বেশি হলেও অনেক প্রসূতি মা অপারেশনেই শিশুর জন্ম চান।

সুতরাং এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে অসচ্ছল ঘরের প্রসূতি মায়ের অ্যাম্বুলেন্স দরকার হলে তার খরচ সরকার দেয়। উপজেলা বা গ্রামের চিকিৎসাকেন্দ্রে শিশু জন্মের জন্য মায়েরা আর্থিক সহায়তা পান। এসবই ভালো উদ্যোগ।

তা ছাড়া সরকার মিডওয়াইফের সংখ্যা বাড়িয়ে তাঁদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। এখন অনেক চিকিৎসাকেন্দ্রে মিডওয়াইফ থাকেন। প্রসবকক্ষও স্বাস্থ্যসম্মত। সব শিশু-মাতৃ চিকিৎসাকেন্দ্রে যেন মানসম্পন্ন ব্যবস্থা থাকে, সেটা নিশ্চিত করা খুব দরকার। এটা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। কারণ, মিডওয়াইফদের পক্ষেই শিশু প্রসবের কাজ সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব। এই পেশায় দক্ষতা বাড়ানোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রাম থেকে শহর—সবখানে সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ নিয়োগ পান এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও সুন্দর পরিবেশের প্রসবকক্ষ থাকে, তাহলে বাসায় শিশু প্রসবের চেয়ে বরং চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রসূতি মা সহজে যেতে চাইবেন। এর ফলে নিরাপদ স্বাভাবিক জন্মের হার বাড়বে।

আরেকটি বিষয় আমাদের ভেবে দেখা দরকার। যদি অপ্রয়োজনীয় সিজারে শিশু জন্মের হার বাড়তেই থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এমন এক অবস্থার উদ্ভব ঘটবে, যখন সিজারে জন্ম নেওয়া শিশুরাই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের মাধ্যমে যেসব শিশু জন্ম নেবে, তাদেরও অপারেশনে জন্মলাভের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। অনেক ক্ষেত্রে এই শিশুদের মাথার আকার একটু বড় হতে পারে। তাহলে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে মানব প্রজাতি হয়তো এমন এক অবস্থায় যাবে, যেখানে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা একটু দুর্বল, মেধায় একটু পিছিয়ে থাকবে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে গেলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেওয়া অসম্ভব নয়।

তবে এটা ঠিক যে প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই অপারেশনে যেতে হবে। শুধু অপ্রয়োজনীয় অপারেশন যেন কমিয়ে আনা যায়, সেটাই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।

আব্দুল কাইয়ুম : প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]