ইসলামিক স্টেট কেন আফগানিস্তানে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আফগানিস্তানের দায়েশ বা ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্থানীয়ভাবে ইসলামিক স্টেট ইন খোরসান (আইএসআইকে) নামে পরিচিত। আল–কায়েদা, ন্যাটো, আফগান সুরক্ষা বাহিনী এবং সিআইএর অর্থায়নে গড়ে ওঠা স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর পাশাপাশি আফগানিস্তানে ক্ষমতার লড়াইয়ে আইএসআইকে অপেক্ষাকৃত নতুন।

২০১৪ সালে দায়েশকে প্রথম আফগানিস্তানে দেখা গিয়েছিল এবং পেন্টাগন গোষ্ঠীটিকে পাকিস্তানি তালেবানের একটি বিচ্ছিন্ন সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করে খারিজ করে দিয়েছিল। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা তিন হাজারের বেশি এবং আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে প্রধানত, কুনার, নানগারহার, নুরিস্তান ও লাঘমান প্রদেশে তাদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে উত্তরের কুন্দুজ ও পশ্চিমের হেরাতে আইএসআইকে তাদের ঘাঁটির বিস্তার ঘটিয়েছে।

কাবুলে তাদের ইউনিটটি সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ ২০১৮ সালে গোষ্ঠীটি কাবুলে এককভাবে ২৪টি হামলা চালায়। এই সংখ্যা হাক্কানি নেটওয়ার্কের চালানো হামলাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল রাখমত আকিলভ নামের একজন উজবেক সুইডেনের স্টকহোমে সন্ত্রাসী হামলা চালান, যাতে পাঁচজন মারা যায়। নানগারহারের একজন আইএস নেতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আকিলভ ওই হামলা চালান। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে আফগানিস্তানে ৩ হাজার ৮৮১ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৪২৩ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী হচ্ছে আইএসআইকে।

প্রথমে পাকিস্তানি তালেবানদের একটি দুর্বল জোট হিসেবে যে গোষ্ঠীটিকে বিবেচনা করা হয়েছিল, সেই আইএসআইকেতে এখন কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার যোদ্ধারা রয়েছেন। বহু আফগান যুবক ও তালেবানের বঞ্চিত সদস্যরাও তাদের যোদ্ধা। যোদ্ধাদের আফগান মানদণ্ডে বেশ ভালো অর্থ দেওয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় এই অর্থের পরিমাণ মাসে কয়েক শ ডলার।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কাঠ, মাদক ও খনি থেকে পাওয়া মূল্যবান পাথর পাচার করে এবং চাঁদাবাজি করে আইএসআইকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা আইএসআইকে আর্থিক সহায়তা দিতেন। কিন্তু এখন তারা স্বনির্ভর হিসেবে বিবেচিত।

২০১৮ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিশনের তৎকালীন কমান্ডার জেনারেল অস্টিন এস মিলার আইএস যোদ্ধাদের নির্মূল করতে আফগান পুলিশ বিশেষ ইউনিটের পাশাপাশি কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের নেতৃত্বে একটি বিশেষ অপারেশন টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে তালেবান দোহার আলোচনায় এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। তারা জানায় যে তারা আইএস বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম। 

আবদুল রহিম মুসলিমদোস্তের মতো কিছু সাবেক আইএস নেতার মতে, আইএসআইকে পাকিস্তানের সৃষ্টি। আফগান সাংবাদিক আবদুল রহিম মুসলিমদোস্ত ইরাকে ও আফগানিস্তানে আইএসের সদস্য ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি আইএস ত্যাগ করেন। তিনি বেশ কিছুদিন পাকিস্তানের কারাগারে ও কিউবার গুয়ানতানামো বের বন্দিশিবিরে আটক ছিলেন।

তবে যে যা-ই বলুক না কেন, আমি বলতে চাই আইএসআইকে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। আমার এ ধারণার পেছনে জোরালো কারণও রয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তানের সীমান্তে পূর্ব আফগানিস্তানে আইএসআইকের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিকে কৌশলগতভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করেন। পেন্টাগনের কর্মকর্তারা ২০১৭ সালের প্রথম দিক থেকে বলে আসছিলেন যে তাঁরা আফগানিস্তানের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইএস বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারবেন না। ২০১৯ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্র আইএসনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর জন্য তার কৌশলে পরিবর্তন আনে। এই কৌশল হচ্ছে ‘রক্ষণাবেক্ষণের’ কৌশল, যেখানে আফগানিস্তানের অন্যান্য জঙ্গি-অধ্যুষিত স্থানে তাদের কৌশল হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’।

আফগানিস্তানে আইএসআইকের প্রায় রাতারাতি উত্থান এবং তাদের মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্রের অনীহায় এই ধারণাই জোরালো হয় যে তালেবানকে দুর্বল করার একটি গোপন প্রচেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই আইএসআইকে গড়ে তুলেছে। বেশির ভাগ মানুষ যে তত্ত্বটি বিশ্বাস করে সেটা হচ্ছে আইএসআইকে সিআইএর সৃষ্ট একটি জঙ্গি সংগঠন, যা মার্কিন সেনাবাহিনী এবং আফগান সরকার গঠন করেছে পুনরুজ্জীবিত হওয়া তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। এ তত্ত্বের আরও একটি বিশ্বাসযোগ্য কারণ হলো আফগানিস্তানে অনেক প্যান-ইসলামিক গোষ্ঠীর উপস্থিতি—তালেবান, আল–কায়েদা এবং এখন আইএসআইকে। একই মতাদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে তারা আফগানিস্তানের মাটিতে ঘাঁটি গেড়েছে। আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল রাখাই তাদের মূল লক্ষ্য। 

মার্কিন সেনাবাহিনী আসলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সেখান থেকে মার্কিন সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি বজায় রাখতে চায়। আর এ জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে আফগানিস্তানকে অস্থিতশীল রাখা। সে কাজটাই করবে আইএসআইকে। আইএসআইকের উত্থান, অর্থের উৎস, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু এসব সন্দেহ দূর করার কি কোনো উপায় আছে? আফগানিস্তান কি আদৌ আইএসআইকের চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটাতে সক্ষম হবে? বলা বাহুল্য, উত্তরটা আমাদের জানা নেই।

দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত


ইনাম উল হক পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল