পরিচ্ছন্নতা.২৮: প্রমাণ করেছি, আমরাও পারি

পরিচ্ছন্নতার পক্ষে প্রচারাভিযান
পরিচ্ছন্নতার পক্ষে প্রচারাভিযান

আমার ছোট ভাই চিকিৎসক মোবিন একাত্তরে লন্ডনের হ্যামারস্মিথ হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির চাকরি ছেড়ে ডাক্তার জাফরুল্লাহকে সঙ্গে করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। খালেদ মোশাররফের তত্ত্বাবধানে সীমান্তে মেলাঘর ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোবিন বিলেতে ফিরে গিয়ে আমাদের অবাক করে দিয়ে তার হাসপাতালের প্রশাসন বিভাগের এক ইংরেজ তরুণীকে বিয়ে করে। সেই তরুণী এখন প্রৌঢ়া। চোখের নিচে ভাঁজ পড়েছে। বয়সের ছাপ। চুলে পাক ধরেছে, তবু দম্ভ ও উন্নাসিকতায় ভাটা পড়েনি। বিয়ের পর মোবিনের স্ত্রী এভরিল একবারই বাংলাদেশে এসেছিল। আর কখনো আসেনি। মোবিন অবশ্য প্রতিবছর ছুটিতে দেশে এসেছে এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে বিনা মূল্যে রোগী দেখেছে।

এভরিল কেন তার সঙ্গে আসে না, জানতে মোবিনকে পীড়াপীড়ি করলে সে জানায়, এভরিল বলেছে, ‘তোমরা নোংরা, ডার্টি পরিবেশে থাকো।’ আরও বলেছে, ‘ইট স্টিঙ্কস, সর্বত্র দুর্গন্ধ।’ তার কথায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। আমরা সবাই ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন ওর আদর-যত্নের কোনো ত্রুটি করিনি। তার সম্মানে বিরিয়ানি-পোলাও-কোর্মা দিয়ে লাঞ্চ-ডিনারের আয়োজন করেছি। লুচি-পরোটা-আলুর দম ব্রেকফাস্ট খেয়েও তো আমাদের উষ্ণ আতিথেয়তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল। এখন কী শুনি?

এভরিলের ওপর তৎক্ষণাৎ রাগ ও অভিমান হলেও বুঝতে পারি ও মিথ্যে বলেনি। তার অভিযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই। এটা তো সত্য যে এভরিল স্বচক্ষে দেখে গেছে আমার বাড়ির সামনে দিনের পর দিন স্তূপীকৃত ময়লা-আবর্জনা। দেখে গেছে ড্রেন ও পয়োনিষ্কাশনের নর্দমা থেকে উপচে পড়া দুর্গন্ধ পানিতে চলার পথ ভেসে যাচ্ছে। আমরা এসব দেখেও দেখিনি। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে হাত-পা গুটিয়ে বসে রয়েছি। থেকেছি সম্পূর্ণ উদাসীন ও নির্লিপ্ত। যেন আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদেরও একটা ভূমিকা ও দায়িত্ব রয়েছে।

সেই বার্তাটিই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল সম্প্রতি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার নজরুল ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন ২৮ নম্বর সড়কের ‘পরিচ্ছন্নতা.২৮’ পরিবেশ আন্দোলন। আন্দোলনের নেতৃত্বে আছেন আমাদের প্রতিবেশী ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বর্তমানে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। আন্দোলনে নারীদের আগ্রহ, উৎসাহ-উদ্দীপনা, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সক্রিয় তৎপরতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেসব নারীকে প্রতিদিন লেক্সাস, বিএমডব্লিউ ও হ্যারিয়ার দামি দামি গাড়ি চড়ে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখেছি, সেই সব ধনী ও অভিজাত শ্রেণির নারীদের ঝাড়ু ও ঝুড়ি হাতে রাস্তা পরিষ্কার করতে দেখেছি। এটি ছিল একটি অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। একটি নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও অবহেলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে এটা ছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা।

পরিচ্ছন্নতা.২৮ ফ্ল্যাটমালিকদের নিয়ে ঘন ঘন নীতিনির্ধারণী সভা করেছে। প্রত্যেক সদস্যকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে তাঁদের নিজ নিজ বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য নজরদারি রাখা হয়। পরিচ্ছন্নতা.২৮ সদস্যদের নিয়ে একটা শোভাযাত্রা বের করে। ব্যানার হাতে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ, প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর জাকির হোসেন ওরফে স্বপন এবং তাঁর বিশাল কর্মী বাহিনী। শোভাযাত্রাটি ২৮ নম্বর সড়ক থেকে শুরু করে ‘আমার পরিবেশ আমারও দায়িত্ব’ স্লোগান দিতে দিতে চারপাশের সড়ক প্রদক্ষিণ করে শেষ হয়। আমি নিষ্ক্রিয় বসে থাকায় নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। তাই আমিও এই বৃদ্ধ বয়সে ভগ্নদেহে পরিচ্ছন্নতা.২৮-এর সরবরাহ করা কমলা রঙের গেঞ্জি পরে শোভাযাত্রায় একগুচ্ছ প্রত্যয়ী তাজা প্রাণের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছিলাম। একটা সৎ উদ্যোগে অন্তত একটিবার সঙ্গী হতে পেরে আমার জীবন ধন্য হয়েছে।

আমরা অসাধ্যসাধন করেছি। এখন আর ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়ক চেনা যায় না। চকচকে, ঝকঝকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা, ড্রেন, নর্দমা ও লেকের পাড়। রাতে রাস্তায় নিয়মিত বাতি জ্বলে। আমার বাসার সামনের অতিপরিচিত সেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ নেই। একটা অভাবনীয় পরিবর্তন। আমরাও পারি।

বিন্দু বিন্দু পানি থেকে পরাক্রমশালী মহাসাগর গড়ে ওঠে। আশা করা যায়, ‘পরিচ্ছন্নতা.২৮’ দ্রুত প্রসারিত হয়ে ‘পরিচ্ছন্নতা.১’-এ রূপান্তরিত হবে এবং ক্রমান্বয়ে শহরের প্রতিটি অঞ্চলে, পাড়ায় ও মহল্লায় বিস্তৃত হবে। শুধু প্রয়োজন একজন দক্ষ সংগঠক, উদ্যোক্তা ও বলিষ্ঠ কমিউনিটি নেতৃত্ব। একজন হোসেন জিল্লুর রহমান ও সবার সম্মিলিত প্রয়াস। তবেই ঢাকা পৃথিবীর একটি নিকৃষ্ট বাসযোগ্য শহর—এই অবাঞ্ছিত অপবাদের লজ্জা ও গ্লানি মুছে ফেলে আমাদের দায়মুক্তি হবে।

আমি এভরিলকে স্কাইপে বলেছি, দোহাই তোমায়, একটিবার এসে দেখে যাও, আমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন হয়েছে। দীর্ঘ ২০০ বছর এবং তারপর ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক দাসত্বের উত্তরাধিকার ও বদভ্যাস বদলাতে কিছুটা সময় লাগবে বৈকি।


আবদুল হান্নান সাবেক কূটনীতিক