নদ-নদী ও মৎস্যসম্পদ রক্ষায় কোরআনের নির্দেশ

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষ সৃষ্টির আগে এ জগতে মানবজাতির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর আয়োজন করে রেখেছেন। মানবজাতি পর্যায়ক্রমে তা আহরণ ও ব্যবহার করে আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবে, এটাই আল্লাহর ইচ্ছা। প্রাণের উৎস পানি। আল্লাহ তাআলা সবকিছু পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। পানিই জীবন। পানি জীবজগতের আদি উৎস। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা কুফরি করে তারা কি ভেবে দেখে না, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি হতে। তবু কি তারা ইমান আনবে না।’ (সুরা-২১ আম্বিয়া, আয়াত: ৩০)।

পানির উৎস সাগর, নদ-নদী বা জলাধার। নদীতে রয়েছে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি প্রবাহিত করেন দুই ধারা, যারা পরস্পর মিলিত হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? উভয় নদী হতে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? সমুদ্রে বিচরণশীল পর্বতপ্রমাণ নৌযানসমূহ তারই নিয়ন্ত্রণাধীন, সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১৯-২৫)। ‘দরিয়া দুটি এক রূপ নয়, একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়, অপরটির পানি লোনা। প্রতিটি হতে তোমরা তাজা গোশত (মাছ) আহার করো এবং আহরণ করো অলংকার (মণি–মুক্তা) যা তোমরা পরিধান করো এবং তোমরা দেখ উহার বুক চিরিয়া নৌযান চলাচল করে যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পারো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা-৩৫ ফাতির, আয়াত: ১২)।

যাতায়াত ও যোগাযোগের আদি প্রাকৃতিক পথ নদী, সভ্যতার উন্মেষ ও পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু নদী। তাই বিশেষ সময়ে শিকার করা বা প্রাণী বধ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। যা তোমাদের নিকট বর্ণিত হচ্ছে তা ব্যতীত চতুষ্পদ জন্তু (আনআম) তোমাদের জন্য হালাল করা হলো, তবে ইহরাম অবস্থায় শিকার করাকে বৈধ মনে করবে না।’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ১-২)। ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের হাত ও বর্শা যা শিকার করে সে বিষয়ে আল্লাহ অবশ্যই তোমাদিগকে পরীক্ষা করবেন, যাতে আল্লাহ অবহিত হন কে তাঁকে না দেখেও ভয় করে। সুতরাং এরপর কেউ সীমা লঙ্ঘন করলে তার জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে। হে মুমিনগণ! ইহরামে থাকাকালে তোমরা জন্তু হত্যা কোরো না;...তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও তা ভক্ষণ হালাল করা হয়েছে, তোমাদের ও পর্যটকদের ভোগের জন্য। তোমরা যতক্ষণ ইহরামে থাকবে, ততক্ষণ স্থলের শিকার তোমাদের জন্য হারাম।’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯৪-৯৬)।

মত্স্যসম্পদ ও প্রাণিসম্পদ রক্ষা করা এবং নির্দিষ্ট সময়ে মত্স্য আহরণ না করা ও বিশেষ সময়ে প্রাণী শিকার না করার নির্দেশনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নদ-নদী জীবনের নিয়ামক। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য, মানবসভ্যতা স্থিতির জন্য এবং প্রাকৃতিক খাদ্যসম্ভার সংরক্ষণের জন্য আমাদের নদী রক্ষা করতে পানিদূষণ বন্ধ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে মত্স্য আহরণ ও প্রাণী শিকার বন্ধ রাখতে হবে।

জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদনে এবং ফল, ফসল ও জীবনের অতিপ্রয়োজনীয় অক্সিজেন তৈরিতে যে উদ্ভিদ বা গাছপালা, লতাপাতা প্রয়োজন, তার জন্য চাই নদী ও পানি। কোরআনের বাণী, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তদ্দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উত্পাদন করেন, যিনি নৌযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তাঁর বিধানে উহা সমুদ্রে বিচরণ করে এবং যিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন নদীসমূহকে।’ (সুরা-১৪ ইব্রাহিম, আয়াত: ৩২)।

মানুষ আল্লাহর দেওয়া প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ বিনষ্ট করে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করে। এর পরিণতি সে দুনিয়াতেই ভোগ করে। এই বিষয়ে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে উহাদিগকে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ৪১)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক

smusmangonee@gmail,com